পুজিবাদের হিংস্র চরিত্র ক্রমান্বয়ে উন্মোচিত হয়ে উঠছে। প্রতিদিন কত মানুষ না খেয়ে আছেন তার কোনো হিসাব নাই।পাটি( কমিউনিস্ট পাটি), যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, টিইউসি’র উদ্যোগে বিগত মাস খানেক সময়ে দক্ষিণ খান, উত্তর খান এলাকায় সহস্রাধিক পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে, দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী। এই সময় কালে টিইউসি, গামেন্ট টিইউসি ও পাটির বেশির ভাগ কাজ টিইউসি উত্তরা অফিসে বসেই চালিয়ে যাচ্ছি। এখানে প্রতিদিনই না খেয়ে থাকা ক্ষুধার্ত অনাহারী মানুষেরা তাদের প্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন অফিসে এসে হাউমাউ করে কাদতে কাদতে বলতে থাকেন তাদের না খেয়ে থাকা যন্ত্রণার কথা। শিশু সন্তানের না খেয়ে থাকার যাতনা প্রকাশ করতে কাদতে কাদতে বুক চাপড়ে বলেন, আমি না হয় না খেয়ে আছি তাতে দুঃখ নাই, আমার এই বাচ্চাটার জন্য কিছু ব্যবস্থা করেন।প্রত্যেকের না খেয়ে থাকা,বাসা ভাড়া দিতে না পারায় গৃহহীন হয়ে পড়া, আরো নানারকম সমস্যা তুলে ধরেন এতসব কষ্টের কথা যা বলে শেষ করা যাবে না।
এরই মাঝে করোনা পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সুযোগ সন্ধানী মালিকরা ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে। এসকল ধান্দাবাজ সুযোগ সন্ধানী লুটেরা মালিকদের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের শ্রমজীবী ভাইবোনেরা এখন প্রায়ই বলে থাকেন যে, এসব মালিকরা করোনা ভাইরাসের চেয়েও ভয়ংকর। তাই মালিকরা বেতন -বোনাস না দিয়ে আমাদের না খাইয়ে মারছে। আবার বেতন আদায়ের আন্দোলন করলে, ভাইরাসের দোহাই দেয়া হয় , কিন্তু করোনাকে উছিলা করে শ্রমিকদের পাওনা বঞ্চিত করবে, অত্যাচার করবে এমন সুযোগ আর দেয়া হবে না। শ্রমিকরা বলছে, না খেয়ে মরার চেয়ে ভাইরাসে মরা অনেক ভাল। তাই বিভিন্ন জায়গায় শ্লোগান উঠেছে, “শ্রমিকের পেটে ভাত নাই – করোনা ভাইরাসের ভয় নাই “।
এখানেই শেষ না। করোনা পরিস্থিতি কালীন সময়েই বহু ঘটনা যা বুঝতে মাত্র দু/একটি ঘটনা উল্লেখ করছি : শ্রমিকদের পাওনা মেরে দিয়ে কোনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা না করে গত বৃহস্পতিবার সকালে লিবাস নীটওয়্যার কারখানার মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে গেলে শ্রমিক ভাইবোনেরা বাধা দেয়। অফিসাররা হুমকি ধামকি দিতে থাকে।সহস্রাধিক শ্রমিক রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। যার ফলে মালামাল অন্যত্র নেয়া হবেনা বলে মালিক পক্ষ আশ্বাস দেয়। কিন্তু রাতের আধারে শতাধিক সন্ত্রাসী দ্বারা জোর পূর্বক মালামাল বের করে নিয়ে যেতে চাইলে শ্রমিকরা বাধা দেয়। পুলিশ ও সন্ত্রাসী যৌথভাবে শ্রমিকদের উপর হামলা চালায় অসহায় নিরস্ত্র শ্রমিকদের উপর। রাত একটার পরে আমার কাছে ফোন আসে যে,মতিঝিলে হেফাজতকে পুলিশ যেভাবে পিটিয়েছিল, শ্রমিকদের উপর সেভাবে হামলা করে পিটাচ্ছে।
আমি গামেন্ট টিইউসি’র কয়েকজন নেতা – কমীকে খবর দেই। আমাদের সেই কমরেডরা মুহুর্তের মধ্যে ছুটে যায়। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও শ্রমিকদের সংগে নিয়ে রাস্তার পাশে থাকা এক ট্রাক পাথর দিয়ে রক্ষা করে শ্রমিক ভাইবোনদের।ততক্ষণে কয়েকজন শ্রমিক জখম হয়, তাদেরকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন কমরেডরা।হ্যা এরাই আসল দেশপ্রেমিক। দিন বা রাতের বিষয় না,নিজের জীবন রক্ষা আগে না, আগে মানুষ, মানবতা, মূল্যবোধ, আগে শেণির স্বার্থে শ্রেণি সংগ্রাম। যেখানেই অত্যাচার, যেখানেই জুলুম সেখানেই সিপিবি, সেখানেই টিইউসি, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী কমীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। মালিক ও সরকারের এহেন ঘৃন আচরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে বিধায় আমাদেরকে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই আর পুজিবাদী আগ্রাসন /মালিকদের শোষণ নিযাতনের বিরুদ্ধে লড়াই একসাথে চালিয়ে যেতে হবে।মালিকরা করোনা ভাইরাসজনিত পরীস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটতে মরিয়া হয়ে উঠছে।
প্যারাডাইস ক্যাবলস এর শ্রমিকদের ১১ মাসের বেতন বাকি। এ বিষয় আলোচনা করতে গত সপ্তাহে কোম্পানির মালিক এর গুলশানের বাসভবনে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি জাগুয়ার, বিএমডব্লিউসহ বেশ কটি গাড়ি। শুনলাম কানাডায় বহুতলা শপিং মল, বাড়ি, গাড়ি সবকিছুই আছে। অথচ যেই শ্রমিকদের শ্রমে ঘামে এই বিশাল অর্থ -বিত্ত সেই শ্রমিকরা আজ না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় অসহায় অবস্থায় দিশেহারা হয়ে ঘুরছে। গত পরশু একটি সভা করে ফেরার পথে ইফতারের কিছুক্ষণ আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন গত ফেব্রুয়ারি থেকে বেতন না দেওয়া কারখানা রেদোয়ানটেক্স ফ্যাশন এর অপারেটর লাভলী বেগম। কী হয়েছে জানতে চাইলে কাদতে কাদতে বলে জানান যে তার বাসায় খাবার নেই, আগের দিন পাসের বাসা থেকে দেয়া কিছু ইফতার খেয়েছিল, আর রোজা রেখেছেন শুধু পানি খেয়ে, আজ ইফতার বা সেহরির সময় কী খাবেন তা তিনি জানেন না। সে সময় লাভলীর সাথে ছিল একই কারখানার আরেক অনাহারে কথা শ্রমিক, যিনি অন্য আরেক পরিবারের সাথে সাবলেট থাকতেন -তাদেরই সাথে খেতেন কিন্তু গত তিন মাস যাবত থাকা খাওয়ার কোনো টাকা দিতে না পারায় তারা বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। পরিশেষে ঠাই হয়েছে না খেয়ে থাকা সহকর্মী লাভলীর বাসায়।
এখন দুজনকেই একসাথে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। আর মালিক শ্রমিকদের সাথে বহুবার বেতন দেওয়ার ওয়াদা করে সেই ওয়াদা ভংগ করেছে, কলকারখানা অধিদপ্তরের সাথে চুক্তি করেও শ্রমিকদের বেতন দেয়নি। স্থানীয় কাউন্সিলর,টিইউসিসহ শ্রমিকদের সাথে দুইবার চুক্তি ভংগ করেছে।মালিক বিজিএমইএ এর সদস্য কিন্তু বিজিএমইএ এবং পুলিশ বিরক্ত হয়ে বলে দিয়েছে ঔ মালিকের দায়িত্ব তারা নিতে পারবে না।টিইউসি হাল ছাড়ার সংগঠন না তাই বায়ারের সাথে কথা বলে শ্রমিকদের মজুরি বায়ার দিবে মমে দায়িত্ব নিয়ে উৎপাদন চালু করেছি।গতকাল ১৯ মে বায়ার নিজে শ্রমিকদেরকে আংশিক মজুরি দিয়েছেন। তবে মালিক এবং সরকারকেই শ্রমিকদের বাচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে।কোথাও সমস্যা দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে যুক্তি যুক্ত সমাধান করে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। তাহলেই কোভিট ১৯ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। তাই আসুন সকলেই মানবতা ও সহনশীলতার সাথে কোভিট ১৯ মোকাবিলা করে শ্রমিক বাচাই,শিল্প বাচাই।
লেখকঃ কাজী রুহুল আমীন, কার্যকারী সভাপতি, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র ও অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র