প্রশ্নোত্তরে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ও করণীয়-এমএম আকাশ।

১. করোনা পরীক্ষা একটা পর্যায়ে আসছে। সারাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে গেছে, করণীয় কী?

উত্তর : করোনা টেস্টের কেন্দ্র রাজধানী এবং সেখানে রক্ত পাঠানোয় অনেক আমলাতন্ত্র ও দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হবে- হচ্ছে। আমাদের টেস্টকেন্দ্র প্রথমে ৬ বিভাগে ও পরে জেলা পর্যায়ে স্থাপন করতে হবে। একইভাবে বিভিন্ন জেলায় করোনা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বাস্থ্য বাজেট সে অনুযায়ী সাজাতে হবে। সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হলে চলবে না। অগ্রাধিকার দিয়ে এই ইউনিট স্থাপনের কাজ করা দরকার। বড় হাসপাতাল চেইনগুলোকে এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এই কাঠামো এখন নেই, তাই প্রথমদিকে ঝঃড়ঢ় মধঢ় হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতাল, নগ্নপদ চিকিৎসক ইত্যাদি সব সম্পদ (মানব+বস্তুগত) ইমার্জেন্সি ভিত্তিতে কাজে লাগাতে হয়েছে। বিএমএ ও অন্য চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাসেবা কাজকেও উৎসাহিত করা হয়েছে। এখন এগুলোকে সমন্বিত ও পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং এসব উদ্যোগকে পরস্পরের মধ্যে হটলাইনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক জীবন্ত রাখতে হবে করিৎকর্মা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক লাগবে, যিনি সবটা নখদর্পণে রাখবেন- তত্ত্বাবধান করবেন।

২. পোশাক খাতের বরাদ্দ, মালিকদের ভূমিকা, শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তাসহ বেতন পেতে করণীয়?

উত্তর : সরাসরি বেতন বিকাশ অ্যাকাউন্টে প্রেরণের এই পদ্ধতিই ঠিক আছে। ব্যাংক কারখানা মালিকের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে এটা পাঠিয়ে দেবে। কোনো শ্রমিক তা না পেলে তার ম্যানেজার ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অভিযোগ পাঠাবে। তবে এজন্য শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে কেন? সরকারকে বিজিএমইএর কাছ থেকে প্রথমে প্রতি কারখানার শ্রমিক তালিকা (গত ৩ মাসের স্যালারি শিটসহ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ) জরুরি উদ্যোগের জন্য সংগ্রহ করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নকেও এই তালিকা সরবরাহ করতে হবে। কোন কারখানাগুলোতে কয় মাসের বেতন বাকি- বেতন পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে কত টাকা দরকার হবে তা মালিক সরকারকে বা ঋণদাতা ব্যাংককে জানাবেন- সে অনুযায়ী কারখানা মালিকের নামে সরকার মজুরি ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল তহবিল বরাদ্দ দেবে। তার পর তা সরাসরি শ্রমিকের অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। কোথাও মালিক গড়িমসি বা দেরি করলে, সরকার নিজে ব্যাংকের মাধ্যমে তা দিয়ে দিক। পরে মালিকের কাছ থেকে সরকার অবস্থা ভালো হলে তা আদায় করে নেবে। এতে পুরো বিষয়টা স্বচ্ছ হবে এবং অশান্তি কম হবে, সংক্রমণ কম হবে, সরকার নগরে বা গ্রামে দরিদ্রদের জন্য আশু সুরক্ষা দিয়ে জনপ্রিয় হবে।

তবে এই টাকা আপাতত ভর্তুকি সুদে ঋণ হিসেবে দিলেও তা পরিশোধের উৎস হবে সম্মিলিত বিজিএমইএ-মালিকদের ক্লাব। তাদের দায়িত্ব নিতে হবে সমবেতভাবে নিজ শ্রেণির ও দেশের সুরক্ষার। সফল মালিকরা বিপদগ্রস্ত মালিককে উপার্জন, মজুরি শোধ, অর্ডার বণ্টন করে পরে টাকাটা উঠিয়ে দিতে সাহায্য করবেন। বর্তমানে যেভাবে ব্যাংকঋণের মাধ্যমে কাজটা করা হচ্ছে তার সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের মতো ঢ়ববৎ সড়হরঃড়ৎরহম শর্ত যোগ করে সেভাবেও এটা করা যায়। সে ক্ষেত্রে মালিকদের জন্য সুদের হার গড় ৪.৫০ শতাংশ ঠিক আছে। কেস বাই কেস ব্যাংক এডজাস্ট করতে পারে- সেই স্বাধীনতা ব্যাংক ও মালিকদের থাকতে পারে!

শ্রমিকদের চাকরির নিশ্চয়তা নির্ভর করবে কারখানা চালু রাখার ওপর। সেটা নির্ভর করবে অর্ডারের নিশ্চয়তা ও মালিকের কারখানা চালু রাখার ইচ্ছার ওপর। কত কারখানা ও কত শ্রমিক অনিবার্যভাবে ছাঁটাই করতে হবে তা মনিটর করে আগে থেকে একটা পরিমাণ অনুমান করা দরকার। কত শতাংশ কমবে হিসাব করে উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের এমএসএমই (গরপৎড়-ঝসধষষ, গবফরঁস ঊহঃবৎঢ়ৎরংব) খাতে বিকল্প কর্মসংস্থানের বা স্বনিয়োজিত বা যৌথ উদ্যোগের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও এমএসএমই উদ্যোক্তা তহবিলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব বা যৌথ সমবায় প্রকল্পের জন্য অনেক কম সুদে ঋণ দেওয়া ও আদায়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেই লক্ষ্যে ছাঁটাইকৃতদের মোবাইল ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে আলাপ শুরু করা যেতে পারে। যতদিন চাকরি বা উদ্যোগ গৃহীত না হচ্ছে ততদিন তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী মালিককে শ্রমিকের প্রাপ্যটুকুও দিতে হবে।

৩. গ্রামাঞ্চলে বরাদ্দ, বণ্টন প্রয়োজন অনুযায়ী সব মানুষের প্রাপ্তি নিশ্চিতে করণীয়?

উত্তর : সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলের অধীনে প্রাপক দরিদ্রদের ডিজিটাল তালিকা গ্রামে গ্রামে করার যে প্রকল্প ছিল তা পূর্ণ করে মোবাইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ধাপে ধাপে ক্যাশ ট্রান্সফার (শহরে ও গ্রামে) চালু করতে হবে। টার্গেট ঠিক করতে হবে কতটি গ্রাম, কতটি মহল্লা ও কতজন লোক কতটুকু সময়ে কভার করা হবে। কীভাবে এবং কবে তালিকা পূর্ণ হবে এবং কে তত্ত্বাবধান করবে তা ঠিক করতে হবে- এটা অবশ্য দীর্ঘমেয়াদি চলমান কর্মসূচিরই অংশ এবং এটাকে এ২চ পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত করতে হবে।

৪. কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণে করণীয়?

উত্তর : ভোক্তা, সরবরাহকারী ও উৎপাদকদের মধ্যে ই-যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সমিতিগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। ভোক্তা সমিতি, সমবায় সমিতি, চেইন স্টোর, দোকান সমিতি, হকার সমিতি, বিক্রেতা সমবায়, ক্রেতা সমিতি, আমদানিকারকদের সমিতি, টিসিবি, ওএমএস, পাইকারি বিক্রেতা সমিতি, সবকিছুকে নেটওয়ার্কের মধ্যে এনে যার যার সরবরাহ চেইনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তা তত্ত্বাবধান ্ও বাজারে প্রয়োজনমতো অপ্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করতে হবে। কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের (চাল, ডাল, লবণ, ভোজ্যতেল, শাকসবজি-মাছ-মাংস-দুধ) সাপ্লাই ও সাপ্লাই চেইন সংরক্ষণে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।

৫. নগরের দরিদ্রদের জন্য কী করণীয়?

উত্তর : রেশন, ওএমএস তালিকা করে ক্যাশ ট্রান্সফার, নিরাপদ কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য চেকআপ সুবিধা, গৃহনির্মাণ, নগর দরিদ্রদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।

৬. সরকারের পাশাপাশি টাকাওয়ালাদের করণীয়, স্থানীয়ভাবে সমাজকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়?

উত্তর : এটা স্বেচ্ছামূলক দানের বিষয়। প্রথমে গুরুত্ব দিতে হবে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলো চালানোর মাধ্যমে অন্যদেরও কর্মসংস্থানের ওপর। সেজন্য সহজ শর্তে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ব্যবস্থা সরকার করেছে তা যাতে তারা কাজে লাগান সে ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. বরাদ্দ, লুটপাট কীভাবে ঠেকানো যায়?

উত্তর : এজন্য দরকার স্বচ্ছতা ও সর্বস্তরে জবাবদিহিতা। ইবহবভরপরধৎু অপপড়ঁহঃধনরষরঃু রং হবপবংংধৎু. নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য বুলেটিনের মতোই আর্থ-সামাজিক খাতে ‘কী করার কথা ছিল, কী করা গেল, কী করা হবে’, তা জাতিকে কেন্দ্রীয়ভাবে সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানানো দরকার।

সাধারণ মন্তব্য

১. করোনা নিয়ে ভয় পেয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর প্রয়োজন নেই। এ রকম ভাইরাস আক্রমণ অতীতেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে, ভাইরাসের মিউটেশন হবে, ১০-১৫ বছর পর আবার সংকট হবে। তাই ‘সংকটের কল্পনাতে আগেই ম্রিয়মাণ হওয়া চলবে না।’ আত্মসচেতনতা ও আত্মশক্তিকেই জাগ্রত করতে হবে। কারও জন্য অপেক্ষা না করে নিজের করণীয় ঠিক করে নিজেই অগ্রসর হতে হবে।

২. এই আক্রমণ শ্রেণি নির্বিশেষে সবার ওপর। এর সমাধানের জন্যও তাই মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সবার ঐক্য লাগবে। তবে গরিবদের জন্য দরকার হবে বিশেষ উদ্যোগ। কারণ তাদের জন্য বিপর্যয়ের মাত্রাও তুলনামূলকভাবে বেশি। সেজন্য তাদের প্রতি অতিরিক্ত সহানুভূতির অংশ হিসেবে করোনাকালে ও করোনা-উত্তর পৃথিবীতে পরিবেশবান্ধব, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি লাগবে আরও বেশি।

৩. ভবিষ্যৎ বাজেটে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি অনুসরণ করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলার কর্মসূচিগুলোকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

৪. সর্বক্ষেত্রে পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে। ব্যক্তি খাত ও রাষ্ট্রীয় খাত, নাগরিক সমাজ ও সরকারি প্রশাসন, জাতীয় শক্তি ও আন্তর্জাতিক শক্তি, বিজ্ঞান ও মানবিকতা, সমতা ও প্রবৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সরকারি দল ও বিরোধী দল এদের পরস্পর পরিপূরকতা লাগবে।

এমএম আকাশ : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(বিঃদ্রঃ ২১ এপ্রিল ২০২০ আমাদের সময় অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত থেকে নেওয়া)

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *