কৃষক না বাঁচলে আমরাও বাঁচব না-লাকী আক্তার

২০১৭ সালের মে মাস। অকালবন্যা ও ঢলের পানিতে হাওরের ধান তলিয়ে গেছে। কৃষক সর্বস্বান্ত। কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর সমিতির নেতাদের একটি দল যাচ্ছে হাওরাঞ্চলে। আমিও তাদের সহযাত্রী ছিলাম। রেলস্টেশনে গিয়েই দেখতে পেলাম মানুষ হাওরাঞ্চলগুলো থেকে দলে দলে ঢাকায় আসছে। ফসল হারিয়ে তাদের ঘরে এখন খাবারের জোগানও নেই। বাধ্য হয়ে ঢাকায় কাজের খোঁজে আসা। কী আছে ভাগ্যে তা জানা নেই, শুধু জানে ঢাকায় গেলে কিছু একটা তো বন্দোবস্ত হবে।

২০১৭ সালের ওই আকালে নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার রানীচাপুর গ্রামের কৃষক নিরঞ্জন অধিকারীর প্রায় সাড়ে ৫ একর জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেল। চোখের সামনেই নিজের দুটো গরুকেও খাদ্যাভাবে মরতে দেখেছিলেন তিনি। গত দুই দিন আগে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি এবার ফলন বেশ ভালো হয়েছে। আশা করছেন ২০০ থেকে ৩০০ মণ ধান তুলতে পারবেন। ইতিমধ্যে ধান কাটা শুরু করলেও শঙ্কায় আছেন দ্রুত কাটা শেষ না হলে এবারও পাহাড়ি ঢলে তার ধান তলিয়ে যেতে পারে। তিনি জানান, এবারও হাওর এলাকায় পর্যাপ্ত নদী খনন হয়নি। রানীচাপুরে কৃষিশ্রমিক ছাড়াও অন্য অনেক শ্রমিক যাদের এখন কাজ নেই তারাও এসে ধান কাটায় যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া কোথাও কোথাও ঢাকা থেকে যাওয়া গার্মেন্ট শ্রমিকরাও ধান কাটছেন।

ঢাকা থেকে যাওয়ার পর এই শ্রমিকদের আলাদা জায়গায় ১৪ দিন থাকার ব্যবস্থা করে গ্রামবাসী। কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জেও এবার ফলন ভালো হয়েছে। তবে সুনামগঞ্জ থেকে কৃষকনেতা চিত্তরঞ্জন তালুকদার জানালেন, করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিক সংকটের কারণে এবার ধান কাটার মজুরি বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে অনেকখানি।তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে হাওর এলাকায় বন্যা শুরু হতে পারে, সে ক্ষেত্রে ওইসব এলাকায় দ্রুত ধান কাটার পদক্ষেপ না নিলে ২০১৭-এর মতো ধান তলিয়ে যেতে পারে। কোথাও কোথাও সরকারিভাবে হারভেস্টার মেশিন ভাড়া দিয়ে ধান কাটতে কৃষককে সহায়তা করা হচ্ছে, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। যেসব এলাকায় ব্রি-২৮ ধান চাষ হয়েছে সেখানে এখনই ধান কাটা শুরু হয়েছে। গাইবান্ধায় ধান পাকতে আরও ২০ দিনের মতো লাগবে কারণ সেখানে মূলত ব্রি-২৯ ও হাইব্রিড ধান চাষ হয়েছে। গাইবান্ধায় এ মুহূর্তে শ্রমিকরা অন্য এলাকায় ধান কাটার কাজে যেতে চাইছেন, কিন্তু যানবাহনের অভাবে ও বিভিন্ন এলাকা লকডাউনের কারণে তা পারছে না। যেমন, নোয়াখালী অঞ্চলে ধান কাটার জন্য শ্রমিকরা বাইরের জেলা থেকে যেতে পারেনিন। ঢল বা বৃষ্টি নামার আগেই কৃষক হয়তো জীবন বাজি রেখে ধান তুলে আনতে পারবেন, কিন্তু এরপর সেই ফসলের লাভজনক দাম কি তারা পাবেন- প্রতি মৌসুমের মতো এ প্রশ্নটিই ঘুরেফিরে সবার মনে।

গত বছরও প্রতি মণে ৩০০-৫০০ টাকা লোকসানে ধান বিক্রি করে দিতে হয় কৃষককে। সরকারি ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে যে ধান কেনা হয় তা মোট উৎপাদিত ধানের খুবই নগণ্য অংশ। এ বছর বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন হলেও এবারের ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে। অথচ সরকার মাত্র ৬ লাখ মেট্রিক টন (২.৯৪ শতাংশ) ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনবে। সেই সঙ্গে সাড়ে ১১ লাখ টন চালও কেনা হবে যাতে আসলে কৃষকের কোনো স্বার্থ নেই বরং চাতাল মালিক ও মিলাররাই এতে লাভবান হবেন। আবার বিভিন্ন সিন্ডিকেট ও অনিয়মের কারণে সরকারিভাবে সামান্য পরিমাণ ধান কেনার সুফলও কৃষক পুরোপুরি পায় না। তাই বাধ্য হয়ে তাকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে কাঁচা ধান বিক্রি করে দিতে হয়। অথচ এ বছর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার মোট উৎপাদিত বোরো ধানের (আড়াই কোটি মেট্রিক টন) ২২ শতাংশ কৃষকের কাছ থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই কৃষকের উদ্দেশে বলে থাকেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। তিনি এও বারবার মনে করিয়ে দেন যে, তার সরকার কৃষিবান্ধব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম না পেয়ে কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। আর তাই প্রতি বছরই আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। কেবল গত মার্চ-জুলাই মৌসুমে খুলনা বিভাগের যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলায় মোট চাষযোগ্য জমির (৬ লাখ ৯৪ হাজার ৬৫৩ হেক্টর) মধ্যে অনাবাদি রয়ে গেছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৩৬ হেক্টর। (প্রথম আলো, ২৫ জুন, ২০১৯)। এই প্রতিবেদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, গত বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলনের পরও ধানের লাভজনক দাম না পাওয়ায় আউশ মৌসুমে ধান চাষে কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এদিকে কিশোরগঞ্জ থেকে আমাদের কৃষক সমিতির নেতা নুরুল হকের ভাষ্য হচ্ছে, ২০১৭ সালে হাওরে ফসল বিপর্যয়ের পর অনেক প্রান্তিক কৃষকই আর ঘুরে দাঁড়াতে না পেরে অন্য পেশা বেছে নেওয়ায় অনেক জমিই অনাবাদি থেকে গেছে। করোনার এই সংকটকালেও কৃষক ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণের অপ্রতুলতার সংকট।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার কৃষক সমিতির নেতা অধ্যাপক ওহিদুজ্জামান পিন্টু একজন ফল চাষি। তিনি জানিয়েছেন, তার এলাকায় কলার অনেক ফলন হয়েছে যা খেতেই নষ্ট হচ্ছে বাজারজাত করতে না পারায়। একই এলাকায় তামাক ও পানের চাষিরাও একই কারণে বিপর্যস্ত। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি ক্রেতার অভাবে টমেটো খেতেই পচে যাচ্ছে। পাইকারি দেড় টাকা-দুই টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে টমেটো। গাইবান্ধায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মিহির ঘোষ জানান, ক্রেতা না থাকায় গরুর খামারিরা প্রতিদিন দুধ ফেলে দিচ্ছেন। গরু যাতে বেশি দুধ না দিতে পারে সেজন্য গরুর খাবার কমিয়ে দিয়েছেন খামারিরা। একদিকে মানুষ খাবারের অভাবে রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হচ্ছে আবার একই সময় ফসল নষ্ট হচ্ছে, দুধ ফেলে দিতে হচ্ছে নর্দমায়। পণ্য সরবরাহ ও লাভজনক দাম নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী মৌসুমে চাষিরা কীভাবে ফসল ফলাবেন!

লকডাউন পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে, কবে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে সেসব যখন অনিশ্চিত, তখন খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রাখাও অনেকখানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভারত ও ভিয়েতনাম আপাতত চাল রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যারা বিশ্বে যথাক্রমে প্রথম ও তৃতীয় বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ। বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া এপ্রিল থেকে জুন অবধি খাদ্যশস্য রপ্তানি সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইউক্রেন জুলাই পর্যন্ত বাকহুইট রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। করোনাকালীন এ দুর্যোগে করোনার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে মানুষের ক্ষুধার কষ্ট। একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেক ধনী ও সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রের দম্ভ চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে নিমিষে। পারমাণবিক অস্ত্র মজুদের চেয়ে তাদের কাছে এখন খাদ্যের মজুদই বেশি জরুরি। কিন্তু কৃষকই যদি না বাঁচে তবে কে মাঠে ফসল ফলাবে! সামনে যে ভয়াবহ খাদ্য সংকট অপেক্ষা করছে সেখানে কেবল কৃষিই পারে আমাদের বাঁচাতে। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আজ কৃষকের জন্য আওয়াজ তোলা দরকার। কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বাধ্য করা আমাদের জন্য নিঃশ্বাস গ্রহণের মতোই জরুরি। ‘চাষি আর চষা মাটি এ দুয়ে হয় দেশ খাঁটি’, প্রায় হাজার বছর আগেই খনা তার বচনে যা বলেছিলেন তা আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দিল এই করোনাকালীন দুর্যোগ।

লেখক : লাকী আক্তার, নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি।

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *