১২-১৬ ধারার কারণে শ্রমিকদের করোনা ভাইরাসের চেয়ে চাকুরী হারানোর আতংক বেশী।

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস এর কারণে গত ২৭ মার্চ থেকে দেশের বেশীর ভাগ গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।প্রথম দিকে গার্মেন্ট মালিকরা কারখানা বন্ধের নুটিশে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর  ১২ এবং ১৬ অনুযায়ী লে-অফ নুটিশ না দিলেও গত ৫ এপ্রিলের পরে বেশীর ভাগ গার্মেন্ট কারখানা বন্ধের নুটিশে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর  ১২ এবং ১৬ অনুযায়ী লে-অফ নুটিশ দিয়েছেন।

বেশীর ভাগ গার্মেন্ট শ্রমিকরা বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর  ১২ এবং ১৬ অনুযায়ী লে-অফকৃত শ্রমিকগণের ক্ষতিপূরণের অধিকার কি আছে তা না জানার কারণে শ্রমিকরা এক প্রকার বিভ্রান্তির মধ্য আছে।

যে সব শ্রমিকরা শ্রম আইন পড়ে জেনেছেন যে, তারা যে ক্ষতিপূরণের টাকা পাবে তা দিয়ে তাদের কোন ভাবেই দিন চলবে না তারা রাস্তায় নেমে ১২ এবং ১৬ ধারার বিরুদ্ধে প্রতীবাদ জানাচ্ছেন।

১২ এবং ১৬ অনুযায়ী এক বত্সর চাকুরী সম্পূর্ণ করিয়াছেন এমন শ্রমিক মোট মূল মজুরীর অর্ধেক এবং তাহাকে আবাসিক ভাতা পাইতেন, তাহার সম্পূর্ণের সমান অর্থাৎ গড়ে এক জন শ্রমিক এক মাসে একটি বেসিকের সমান মজুরী পাইবেন।

বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের নিম্নতম বেসিক মজুরী ৪,১০০ টাকা।এই ৪,১০০ টাকা দিয়ে শ্রমিকরা কি ভাবে বেঁচে থাকবে? এবং যেসব শ্রমিকের চাকুরীর বয়স এক বছরের নিচে তারা কোন ধরণের ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেনা। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আছে যাদের চাকুরীর বয়স এক বছররের নিচে তারাই বা কি ভাবে বেঁচে থাকবে?

অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের সুযোগ নিয়ে বেশীর ভাগ কারখানার মালিক, যে সব শ্রমিকের চাকুরীর বয়স এক বছরের নিচে, তাদের কারখানায় ডেকে তাদের আইডি কার্ড জমা নিয়ে বিভিন্ন কাগজে স্বাক্ষর রেখে, কোন পাওনাদী না দিয়েই চাকুরী চ্যুত করা হচ্ছে এবং কিছু কিছু কারখনা নুটিশ দিয়ে ২০ ধারা অনুযায়ী ছাঁটায় করছে। কিছু কিছু কারখনা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শ্রমিকদের চাকুরী চ্যুত করছেন।

যদিও সরকার বার বার বলছেন ‘’কোন কারখানায় শ্রমিক ছাঁটায় করা যাবেনা’’ কিন্তু আমরা দেখছি সরকারের এই কথায় গার্মেন্ট মালিকরা পাত্তা দিচ্ছেন না। প্রতিদিন ছাঁটায় চলছেই। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পরিবার নিয়ে অনাহারে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। অথচ এই শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিচ্ছে।

গার্মেন্ট মালিকরা বাংলাদেশে ৪০ বছরের বেশী সময় ব্যবসা করছেন। অল্প কিছু পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে আজ তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এই শ্রমিকদের শোষণ করেই। বাংলাদেশে গার্মেন্ট মালিকরা করোনা ভাইরাসের দুর্যোগময় পরিস্থিতে শ্রমিকদের পাশে থাকার পরিবর্তে তারা শ্রমিকদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে। শ্রমিকরা আজ করোনা ভাইরাসের আতংকের চেয়ে চাকুরী হারানোর আতংকে বেশী ভুগছে।

  • সরকারের উচিৎ ছাঁটায়কৃত শ্রমিকদের পূনবহালের ব্যবস্থা করা এবং কোন কারখানায় শ্রমিক ছাঁটায় যাতে না হয় তার ব্যবস্থা করা।
  • ১২ এবং ১৬ ধারা বাতিল করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, যাতে শ্রমিকরা গ্রস অনুযায়ী বেতন পাওয়া নিশ্চিত হয়।
  • যে সব কারখানার মালিক এখনো মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ করেনি সে সব মালিকদের বিরুদ্ধে আইন গত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১২ ধারা এবং ১৬ ধারা এখানে সম্পুর্ণ তুলে ধরলাম।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১২ ধারা অনুযায়ী কাজ বন্ধ রাখা।

(১) অগ্নিকান্ড, আকষ্মিক বিপত্তি, যন্ত্রপাতি বিকল, বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ, মহামারী, ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা অথবা মালিকের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অন্য কোন কারণে প্রয়োজন হইলে, কোন মালিক যে কোন সময় তাহার প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বা শাখাসমূহ আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন এবং যে কারণে উক্তরূপ বন্ধের আদেশ দেওয়া হইবে তাহা বিদ্যমান থাকা পর্যনত্দ এই বন্ধের আদেশ বহাল রাখিতে পারিবেন। কাজ বন্ধ রাখা

(২) যদি উক্তরূপ বন্ধের আদেশ কর্মসময়ের পরে দেওয়া হয়, তাহা হইলে পরবর্তী কর্মসময় শুরু হওয়ার আগে মালিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট শাখার নোটিশ বোর্ডে বা কোন প্রকাশ্য স্থানে নোটিশ সাঁটিয়া বা লটকাইয়া দিয়া উক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগণকে অবহিত করিবেন।

(৩) উপ-ধারা (২) এ উল্লিখিত নোটিশে বন্ধ পরবর্তী কাজ কখন শুরু হইবে এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগণকে কাজ পুনরায় শুরু হওয়ার পূর্বে কোন সময় তাহাদের কর্মস্থলে অবস্থান করিতে হইবে কি না তৎসম্পর্কে নির্দেশ থাকিবে।

(৪) যদি উক্তরূপ বন্ধ কর্মসময়ের মধ্যেই সংঘটিত হয়, তাহা হইলে মালিক উপ-ধারা (২) এ উল্লিখিত পন্থায় নোটিশ মারফত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগণকে যথাশীঘ্র সম্ভব তৎসম্পর্কে অবহিত করিবেন, এবং এই নোটিশে পরবর্তী কাজ কখন শুরু হইবে এবং শ্রমিকগণ কর্মস্থলে অবস্থান করিবেন কি না তৎসম্পর্কে নির্দেশ থাকিবে।

(৫) উক্তরূপ কাজ বন্ধের পর যে সমস্ত শ্রমিককে কর্মস্থলে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হইবে, তাহাদের এই অবস্থানের সময় এক ঘণ্টার কম হইলে তাহারা কোন মজুরী নাও পাইতে পারেন, এবং এই অবস্থানের সময় ইহার অধিক হইলে তাহারা অবস্থানকালীন সম্পূর্ণ সময়ের জন্য মজুরী পাইবেন।

(৬) যদি কাজ বন্ধের মেয়াদ এক কর্ম দিবসের চেয়ে বেশী না হয়, তাহা হইলে সংশ্লিষ্ট কোন শ্রমিক, উপ-ধারা (৫) এর ৰেত্র ব্যতীত, কোন মজুরী নাও পাইতে পারেন।

(৭) যদি কাজ বন্ধের মেয়াদ এক কর্ম দিবসের অধিক হয় তাহা হইলে, সাময়িক বা বদলী শ্রমিক ব্যতীত, সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক শ্রমিককে এক দিনের অতিরিক্ত সকল বন্ধ কর্ম দিবসের জন্য মজুরী প্রদান করা হইবে।

(৮) যদি কাজ বন্ধের মেয়াদ তিন কর্ম দিবসের অধিক হয়, তাহা হইলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকগণকে ধারা ১৬ এর বিধান অনুযায়ী লে-অফ করা হইবে।

(৯) উপ-ধারা (৮) এ উল্লিখিত লে-অফ কাজ বন্ধ হওয়ার প্রথম দিন হইতেই বলবৎ হইবে, এবং প্রথম তিন দিনের জন্য প্রদত্ত কোন মজুরী সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে প্রদেয় লে-অফকালীন ক্ষতিপূরণের সহিত সমন্বিত করা হইবে।

(১০) কাজ বন্ধের কারণে যদি কোন ঠিকা-হারের শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হন তাহা হইলে উপ-ধারা (৯) এর প্রয়োজনে তাহার পূর্ববর্তী এক মাসে গড় দৈনিক আয়কে দৈনিক মজুরী বলিয়া গণ্য করা হইবে।

 

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৬ ধারা অনুযায়ী  লে-অফকৃত শ্রমিকগণের ক্ষতিপূরণের অধিকার

(১) যে ক্ষেত্রে বদলী বা সাময়িক শ্রমিক নহেন এরূপ কোন শ্রমিককে, যাহার নাম কোন প্রতিষ্ঠানের মাস্টার রোলে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং যিনি মালিকের অধীন অন্ততঃ এক বত্সর চাকুরী সম্পূর্ণ করিয়াছেন, লে-অফ করা হয়, তাহা হইলে মালিক তাহাকে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত তাহার লে-অফের সকল দিনের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবেন৷

(২) উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হইবে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মোট মূল মজুরী এবং মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অর্ন্তবর্তী মজুরী, যদি থাকে, এর অর্ধেক এবং তাহাকে লে-অফ করা না হইলে তিনি যে আবাসিক ভাতা পাইতেন, তাহার সম্পূর্ণের সমান৷

(৩) যে বদলী শ্রমিকের নাম কোন প্রতিষ্ঠানের মাস্টার-রোলের অন্তর্ভুক্ত আছে, তিনি এই ধারার প্রয়োজনে বদলী বলিয়া গণ্য হইবেন না যদি তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানে অবিচ্ছিন্নভাবে এক বছর চাকুরী সম্পূর্র্র্ণ করিয়া থাকেন৷

(৪) মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে ভিন্নরূপ কোন চুক্তি না থাকিলে, কোন শ্রমিক এই ধারার অধীন কোন পঞ্জিকা বত্সরে পঁয়তাল্লিশ দিনের অধিক সময়ের জন্য ক্ষতিপূরণ পাইবেন না৷

(৫) উপ-ধারা (৪) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোন পঞ্জিকা বত্সরে কোন শ্রমিককে অবিচ্ছিন্নভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে পঁয়তাল্লিশ দিনের অধিক সময়ের জন্য লে-অফ করা হয়, এবং উক্ত পঁয়তাল্লিশ দিনের পর লে-অফের সময় যদি আরোও পনের দিন বা তদূর্ধ্ব হয়, তাহা হইলে উক্ত শ্রমিককে, শ্রমিক এবং মালিকের মধ্যে ভিন্নরূপে কোন চুক্তি না থাকিলে, পরবর্তী প্রত্যেক পনের বা তদূর্ধ্ব দিনসমূহের লে-অফের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করিতে হইবে৷

(৬) উপ-ধারা (৫) এ উল্লিখিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হইবে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মোট মূল মজুরী এবং মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অন্তর্বর্তী মজুরী, যদি থাকে, এর এক-চতুর্থাংশ এবং যদি আবাসিক ভাতা থাকে, তাহার সম্পূর্ণের সমান৷

(৭) কোন ক্ষেত্রে যদি কোন শ্রমিককে কোন পঞ্জিকা বত্সরে উপরে উল্লিখিত প্রথম পঁয়তাল্লিশ দিন লে-অফের পর কোন অবিচ্ছিন্ন পনের দিন বা তদূর্ধ্ব সময়ের জন্যে লে-অফ করিতে হয়, তাহা হইলে মালিক উক্ত শ্রমিককে লে-অফের পরিবর্তে ধারা ২০ এর অধীন ছাঁটাই করিতে পারিবেন৷

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *