করোনা ভাইরাস আমাদের সামনে ‘উৎকৃষ্ট’ স্বাস্থ্য ব্যবসার স্বরূপ তুলে ধরেছে সারাবিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত অগ্রগতি হওয়া পরও কেন এই মহামারী এবং এর কাছে আমরা কত অসহায়।
যাদের উন্নত দেশ বা পুজিবাদী রাষ্ট্র বলি তাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে বেহালদশা এখন প্রকাশ পেয়েছে। এই তথাকথিত উন্নত দেশগুলির স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে এবং এই রোগ কোনওক্রমে ঠেকিয়ে রাখা ও সম্ভব হচ্ছে না। জীবনযাপনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় স্বস্থ্যসেবাকে মুনাফার আখড়া বানালে তো এর ফল ভোগ করতেই হবে। মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত সরকারি ব্যয় কমে গেছে। পূর্ব ইউরোপের ( ফিনন্যাল্ড বাদে) কয়েকটি দেশে স্বাস্থ্যখাতে ৩০ শতাংশ সরকারি ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারিকরণের ফলে অনেক অংশের মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে, কারণ মৌলিক চাহিদা চিকিৎসা ও ঔষধের দাম নাগালের বাইরে। আমরা যদি একটু সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করি সারা বিশ্বের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ছে, শেয়ার বাজারে ধস শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে তাকালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও একটি শিল্পের শেয়ারের মূল্য বেড়েছে কয়েকশ গুন। এই অবস্থায়ও কারো কারো জন্য পৌষ মাস। ফ্রান্সের জিলো সায়েন্সেসের করোনা ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিভাইরালের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের খবর বাজারে আসা মাত্র ওই কোম্পানির শেয়ারের মূল্য ২০% বেড়ে যায়। আইএনও-৪৮০০ নামের একটি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের কথা ঘোষণার পরে ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারের মূল্য ২০০% বেড়ে যায়। মাস্ক প্রস্তুতকারী আলফা প্রো টেক-এর ২৩২%, টেস্ট কিট প্রস্তুতকারী কো-ডায়াগনস্টিকসের শেয়ারের মূল্য ১,৩৭০% বেড়ে যায়।
এই অর্থনৈতিক অবস্থায় যেখানে বড় বড় কোম্পানি মুখথুবরে পড়ছে সেখানে ঔষধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে হইচই কেন? তাহলে কি এই মহামারির মধ্যে ঔষধ কোম্পানি গুলো বিপুল ব্যবসায়িক লাভের সম্ভাবনা দেখছে? তাহলে কি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলির কাছে করোনা ভাইরাস হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। বিশ্বব্যাপী এই ভয়াবহ সংকটের মধ্যে কোম্পানি গুলো তাদের বিক্রয় ও মুনাফা বাড়িয়ে তুলবে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কর্পোরেট ফার্মাকোম্পানির ছোঁয়াচে রোগের প্রতিরোধ নিয়ে গবেষণায় কোনও আগ্রহ নেই। ছয়ের দশক থেকেই করোনা ভাইরাস গোত্রের সন্ধান পাওয়া গেলেও আজ পর্যন্ত কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কার হয় নি। সার্স বা মার্স ভাইরাস বেশ কিছুদিন আগেই এসেছে তারপর এ ব্যাপারে তারা চুপ ছিলেন এবং কোন ধরনের গবেষণা করা হয় নি। একদিকে অর্থাভাবে সরকারি স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রগুলি ভেঙ্গে পড়েছে অন্যদিকে বড় ফার্মার আগ্রহ খুব কম বা কোনও আগ্রহ নেই বললেই চলে। কারণ আমরা যত বেশি অসুস্থ হব তারা তত বেশি মুনাফা করবে। এই অবস্থা উন্নত পুজিবাদী রাষ্ট্রের। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের মধ্য দিয়ে ।
এখনো তেমন ভাবে ছড়ায়নি তাতেই যদি এই অবস্থা ভবিষ্যৎতে আরো খারাপ সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ১৭ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ২৯ টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত করা হয়েছে করোনা রোগীদের জন্য সেগুলো ঢাকার মধ্যে। ডাক্তার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রতিরক্ষামূলক কিছু নেই বলেই চলে। এর মধ্যেই একজন ডাক্তার মারা গিয়েছেন আরো ৫০ জন করোনা আক্রান্ত। আমরা কি হঠাৎ করেই এই অবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি তা কিন্তু নয়।
আমাদের দেশেও সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সংকোচন হয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা বেড়েছে। প্রতি বছর ব্যঙ্গের ছাতার মত গড়ে উঠছে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা যা অনেক ব্যয়বহুল। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।কোন রোগীকে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা পেতে চাইলে ৬৭% খরচ তাকে বহন করতে হয়। হিসাব করলে দেখা যায় প্রতিবছর ৩৫ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবার খরচ মেটাতে দারিদ্রের কবলে পড়ে। সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যাও অতি নগন্য, ৬৬০০ জনের বিপরীতে একজন ডাক্তার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দেশের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে জিডিপির নির্দিষ্ট অংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা তাদের সুপারিশ জিডিপির ৫% বরাদ্দ করা। কিন্তু সেখানে দেখা যায় বাংলাদেশের বরাদ্দ . ৯৩% তা এক শতাংশের কম।
অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাই ক্রান্তিকালীন সময়ে আমাদের এত হিমশিম খেতে হচ্ছে । এত উন্নয়নশীল দেশ আমাদের সেখানে স্বস্থ্যসেবার এই বেহাল দশা। স্বাস্থ্যব্যবস্থা নামে ব্যবসা চালু যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকারে তুচ্ছ করা হচ্ছে। এই করোনা ভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রের কোন খাতে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করতে হবে। “কিউবা” জন্মলগ্ন থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে বলেই আজ তারা করোনাকে রুখে দিতে পেরেছে। উন্নত দেশ গুলো যখন করোনা চিকিৎসা দিতে পেরে উঠছিল না তখন বিভিন্ন দেশে চিকিৎসক পাঠাচ্ছে সহায়তা করার জন্য। আমাদের পাশের দেশ কেরেলা তারা করোনা মোকাবেলায় সাফল্য দেখিয়েছে। উত্তর কোরিয়া, কেরেলা যে পদ্ধতি অবলম্বন করোনার সংক্রমন কমিয়ে আনতে পরেছে তা হলো প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষা করতে হবে।
সর্বোচ্চ সংখ্যক লোককে এই করোনা পরীক্ষার আওতায় নিয়ে এসে করোনা রোগীকে আদালা করতে পারলেই এই ভয়াবতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু আমাদের এখানে ঢিলাঢালা অবস্থা চলছে।
এখনও তেমন কোন প্রসতুতি দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্নটা হচ্ছে এটা সাধ্যের নাকি সদিচ্ছার?
লিখেছেনঃ কাজী রিতা, রাজনৈতিক কর্মী।