বিশ্বখ্যাত লেখক ও ঔপন্যাসিক ‘মার্ক টোয়েন ‘বলেছিলেন, “জীবনে সফল হতে চাইলে দুইটি জিনিস প্রয়োজন: জেদ আর আত্মবিশ্বাস”।
এই উক্তিটির সাথে মিলে গিয়েছে তেমন একজন সুবিধা বঞ্চিত ছাত্রের নাম ‘প্রান্ত দাস’।
যে অদম্য মনোবলে জয় করে নিতে পেরেছে সব প্রতিকূলতাকে, সব প্রতিবন্ধকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্বপ্ন বুননের প্রথম সোপানে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে।
২০০৫ সালে ভোলা জেলার ‘চকঢোস’ গ্রামে বাবা দরিদ্র কৃষক’বাবুল দাস ও মা কৃষ্ণা রানী দাস’ এর ঘর আলো করে জন্ম নেয় ছোট্ট ‘প্রান্ত’। কিন্তু বিধাতা হয়তো সেদিনই তার ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন জীবনের কঠিনতম বাস্তবতাকে। জন্মেই হারালো মাকে। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন যেতে না যেতেই বাবা পুনরায় বিয়ে করে সংসারী হলেন বটে, কিন্তু ছোট্ট ‘প্রান্ত’ এর দায়িত্ব নিতে রাজী হন নি তার সৎমা।
দেখাশোনা করবার কেউ থাকে না সেই ছোট্ট শিশুটির।
এমন অবস্থায় ইচ্ছে-অনিচ্ছায় ছোট্ট প্রান্তের দায়িত্ব নেন কাকী ‘রূপালী রানী দাস’। তাদের অভাবের সংসারে বাড়তি একজন শিশু বড় হওয়ার ও ভরণপোষণ অনেকটাই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও তাকে আগলে রেখেছিলেন কাকা ‘সুনীল চন্দ্র দাস’। যখন সে ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগলো তখন শুরু হলো তার ছোট ছোট হাতে এ-ওর ফাইফরমাশ মিটানো,সারাদিন মাঠে গরু চরানো ও দুধ বিক্রি ছিল তার কাজ। এই করেই কাটতে লাগলো তার শৈশব এর সোনালি সময় গুলো। যখন সবাই বই নিয়ে স্কুলে যেতো তখন তার সারাদিন কাটতো রাখাল হয়ে। শৈশব আর কৈশোরের দুরন্তপনা, আদর,শাসন কিছুই সে স্মরণ করতে পারলো না শুধু কিছু দূ:সহ কষ্ট জড়ানো স্মৃতি ছাড়া। তবে এই শিশুটির প্রতি ছিল বিদ্যা দেবীর অপার করুণা।কারণ পড়ালেখার প্রতি ছোটবেলা থেকেই ছিল প্রচন্ড আগ্রহ।ছোট্ট শিশুটি এতো পরিশ্রমের পরও গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে গরু বেঁধে বারান্দায় বসে শিক্ষকদের পড়া শুনতো আর নিজেই পড়তো।শিশুটির পড়ালেখার প্রতি এতো আগ্রহ দেখে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দেন। সকালে দুধ বিক্রি আর সারাদিন রাখালের কাজ করেও সে বিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু পরিবার তার পড়াশোনার বিষয় মেনে নিতে পারে না।তখন শুরু হয় তার উপর অত্যাচার, কোন কোন দিন ঠিকমতো ভাত জুটতো না,শারীরিক অত্যাচার সবকিছু মিলিয়ে ছোট্ট ‘প্রান্ত’ দিশাহারা অবস্থা। এই দুঃসহ সময়ে শিশু ‘প্রান্ত’ একদিন বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়ে স্থানীয় এক কাঠমিস্ত্রীর বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু অভাবের সংসারে সে বোঝা হয়ে দাঁড়ালেও মনে মনে তিনি ভেবেছিলেন ছেলেটির জন্য তাঁর কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এই আশায় তিনি প্রান্তকে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম শহরে কালুরঘাট মোহরা এলাকায় এবং একটা গ্রীল ওয়ার্কশপের কাজ জুটিয়ে দেন। সারাদিন ওয়ার্কশপে কাজের পরেও রাতে সে বই নিয়ে বসতো।
যা দেখে দোকান মালিক তাকে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবেন এবং এমন একটা বিদ্যালয়ের খোঁজ করেন যেখানে ছেলেটি পড়াশুনার পাশাপাশি হাতে-কলমে কাজ শিখতে পারবে। তাঁর এই ইচ্ছার কথা স্থানীয় ডাঃ আবুল কাসেম সাহেবকে জানালে তিনি জানলেন,সমাজের ‘সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের’ পড়াশোনা করতে সাহায্য করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার নাম ‘ইউসেপ বাংলাদেশ’। একদিন ‘প্রান্ত’কে সাথে নিয়ে ইউসেপ বাংলাদেশ’ পরিচালিত ‘এ. কে. খান ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুল মোহরা, কালুরঘাট, চট্টগ্রাম’ এই বিদ্যালয়ে আসেন। এই বিদ্যালয়ের ‘দীপক কুমার মিত্র’ স্যার ও ‘অনীল চন্দ্র দাস’ স্যারের সহযোগিতায় সে এই বিদ্যালয়ে ‘৫ম শ্রেনীতে’ভর্তির সুযোগ পায় এবং PSC পরীক্ষায় ৪.৮৩ জিপিএ প্রাপ্ত হয় ও ৮ম শ্রেনীতে করোনা কালীন সময়ে অটোপাস করে পরবর্তীতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি সারা রাত গ্রীল ওয়ার্কশপে কাজ করেও সকালে যথারীতি বিদ্যালয়ের পড়ালেখা চালিয়ে যায়। অভাব আর্থিক টানাপোড়েন এর মাঝে অভিভাবকহীন অবস্থায় সে তার পড়াশোনা চালায়।সারা রাতের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে কখনো কখনো ক্লাসে উপস্থিত হওয়াও অসম্ভব হয়ে যেতো।কিন্তু শিক্ষকদের সহযোগিতা, অনুপ্রেরণা,প্রেষণা তার সব ক্লান্তি দূর করে তাকে স্বপ্ন দেখাতো সুন্দর আগামীর।যার ফলস্বরূপ সে ‘এস এস সি’ পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ প্রাপ্ত হয় ও সরকারি পলিটেকনিক্যালে পড়বার সুযোগ পায়।
যে শিশুটি হারিয়ে যেতো অন্ধকারের গহীনে তার মধ্যেই উঁকি দিলো সম্ভাবনার ছায়া। ইউসেপের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া হাজারো ‘প্রান্ত’ যারা আজ পরিচিত হয়েছে নিজেদের পরিচয়ে। প্রান্তের জন্যেও রয়েছে তেমনি সোনালি দিনের হাতছানি।
‘এ,কে,খান ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুল’এর শিক্ষকদের সহযোগিতা ও নিজের ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে সামিল হলো আলোর মিছিলে। তার জন্য অপেক্ষা করছে আরো সুন্দর ও সার্থক আগামী।
‘প্রান্ত’ তার বিদ্যালয়ের শেষদিন বিনম্র চিত্তে স্মরণ করলো তাকে এগিয়ে দেয়া মানুষগুলোকে,শ্রদ্ধা জানালো বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো প্রতিষ্ঠানের প্রতি।