বামপন্থিদের সংগ্রাম বেগবান করতে হবে-মাহমুদ হোসেন

রাজনীতিকদের কথা,পাল্টা কথা আর প্রতিদিনের দোষারোপের পুরোনো খেলা যথারীতি প্রচারমাধ্যমে আসছে। এসবই এখন রাজনীতির অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এসবই যেন এখন দেশের রাজনীতি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একই দিনে কর্মসূচি দেওয়া এবং ঐ কর্মসূচির খবর সংগ্রহে প্রচারমাধ্যমের ব্যস্ত থাকা এবং খবরে কোন দলের খবর কতটুকু দিয়ে সন্তুষ্টি(!) রক্ষা করা যায়, এগুলোও যেন খবরের আরেক বিষয়। এসবের প্রধান অংশজুড়ে পরস্পরের দোষারোপ এবং নির্বাচন ঘিরে একই চর্বিত চর্বন-এটাই তো চলছে।

অন্যদিকে বাজারে চাল, ডাল, তেল , চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ছে। নিয়মিত সব পণ্যের বাড়ানোর আয়োজন সম্পন্ন করে মানুষকে জানান দেয়া হয়েছে, ‘দাম বাড়বে প্রয়োজনে প্রতি মাসে, হিসাবে রেখো(!)’। টিসিবি’র দোকানে, খোলা বাজারে বিক্রি হওয়া পণ্যের ট্রাকের সামনে-পেছনে লম্বা লাইন বাড়ছে, গায়ে গায়ে লাগা মানুষ বাড়ছে। শুধু একেবারে কম আয়ের সাধারণ মানুষ না, মধ্যবিত্তেরও ভরসা খোলা বাজারের ট্রাকের ও টিসিবি’র পণ্য। পণ্য না পেয়ে লাইন থেকে ফিরে যেতে হচ্ছে অনেককে।

ওষুধসহ অন্যান্য ব্যবহার্য পণ্যের দামেরও একই অবস্থা। অথচ এসময়ে অধিকাংশ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং প্রকৃত আয় অনেক কমে গেছে। সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া আর ধার-দেনা করে চলা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। শ্রমজীবী মানুষের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরির দাবি উপেক্ষিত থাকছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ছোট ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্রাম-শহরে কাজ না থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। হাতপাতা মানুষের সংখ্যাতো বাড়ছেই।

দুর্নীতি, লুটপাট, দখলদারিত্ব থেমে নেই। দেশের বাইরে টাকা পাচার, খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এসব রোধ করার, টাকা ফেরত আনার কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ব্যাংকের টাকা নয়ছয়-এর খবরে মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ‘সংকট বাড়বে’, এ কথা বলেই দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে। আর ছক কষা হচ্ছে কীভাবে ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখা যায়।

তাইতো কথার পিঠে কথা আর ক্ষমতার দেশি-বিদেশি খুঁটিকে সন্তুষ্ট করতে নানমুখী পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে। একই পথে হাঁটছে শুধুমাত্র ক্ষমতাশ্রয়ী বিরোধীদল নামধারী দলসমূহ।

আসন্ন সংকট মোকাবিলায় আইএফএফ-এর কাছ থেকে ঋণ নিতে তাদের শর্ত মানতে সরকারের কোনো বড় রাখঢাক থাকছে না। মূল্য সমন্বয়ের নামে দাম বৃদ্ধি, বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার চলছে। সরকারি সম্পত্তি বেসরকারিকরণের নামে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, লুটপাটের সুযোগ প্রসারিত করা হচ্ছে। এর ফলে কমিশনভোগী আমলা আর অসৎ রাজনীতিকদের পকেট ভারী হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি’র কাছে ধর্না বাড়ছে। আর এসবের পরিণতিতে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের অর্থনীতির ধারার বিপরীতে মুক্তবাজারের দামে লুটপাটের অর্থনীতির ধারাকে প্রসারিত করা হচ্ছে। মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। প্রতিবছর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে বলেই সমাজে বৈষম্য তীব্রতর হচ্ছে।

সরকারের দায়িত্বহীন আচরণ আর নালিশ পার্টিদের প্রশ্রয়ে ‘গণতন্ত্র’, ‘মানবাধিকার’ এর কথা বলে সাম্রাজ্যবাদ, বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ বাড়িয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে মর্যাদাহীন করে এরা যার যার সুবিধামত জোট, স্বার্থে বাংলাদেশকেও আবদ্ধ করে ব্যবহার করতে চাইছে। ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর গোষ্ঠীর কাছে এরাই যেন ‘সোনার হরিণ’ হয়ে উঠছে।

এর বাইরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)সহ বামপন্থিদের নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক জোট, বাম গণতান্ত্রিক জোট জনগণের দাবি আদায় করে দেশকে অগ্রসর করতে মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। অনেকদিন পর গত ২০ জানুয়ারি ঢাকার রাজপথে সিপিবির আহ্বানে হাজার হাজার মানুষের লাল পতাকার দীর্ঘ মিছিল অনুষ্ঠিত হলো। প্রচারমাধ্যমে এসব খবর সামান্য এসেছে। দ্বি-দলীয় রাজনীতি যারা টিকিয়ে রেখে প্রকারান্তরে দুর্নীতি, লুটপাট আর বৈষম্যের ধারা টিকিয়ে রাখতে চায়, চায় ভাগ-বাটোয়ারায় নিজেদের আধিপত্য, তারাতো এই বিকল্প বাম শক্তিকে সামনে আনতে দেবে না। তাই এসব খবর এড়িয়ে যাবে,এটাই স্বাভাবিক। সিপিবির ২০ জানুয়ারির সমাবেশ ছিল সুসংগঠিত রাজনৈতিক সমাবেশ। ঢাকা ও এর আশপাশ থেকে নেতাকর্মীরা মিছিল করে সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। ওই মিছিলে নেতা-নেত্রীর নামে সেøাগান ছিল না। শ্লোগান ছিল নিজস্ব অধিকার আদায়ের। ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার। দুর্নীতি, লুটপাট, দখলদারিত্ব উচ্ছেদ, পাচারের টাকা ফেরত আনা, খেলাপি ঋণ উদ্ধার ও এর সাথে জড়িতদের শ্বেতপত্র প্রকাশ ছিল স্লোগানের বিষয়বস্তু। মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ, সিন্ডিকেট ভাঙা, মানুষ বাঁচাতে সর্বত্র রেশন ব্যবস্থা ও ন্যায্য মূল্যের দোকান চালুসহ বিভিন্ন দাবি ছিল সব শ্রেণিপেশার মানুষের। সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ দুঃশাসনের অবসান ও ব্যবস্থা বদলের শ্লোগানে সোচ্চার ছিলেন নেতাকর্মীরা। এই সমাবেশ থেকে বর্তমান সংকট সমাধানে ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচিতে বলা হয়, “সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারসহ নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানো, রেশনিং-ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু, পাচারের টাকা ফেরত আনা, খেলাপি ঋণ উদ্ধার ও এর সাথে জড়িতদের শ্বেতপত্র প্রকাশ, দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধ, দুঃশাসনের অবসান, ব্যবস্থা বদল ও বিকল্প গড়ার সংগ্রাম জোরদার করতে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করছি।

এই সংগ্রামে সকল বামপন্থি, বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দল, সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে আমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে আর কালক্ষেপণ না করে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও নির্দলীয় তদারকি সরকারের রূপরেখা প্রণয়নে আলোচনা শুরু করতে সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি দুঃশাসনের অবসান, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারসহ নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলন বেগবান করার আহ্বান জানাচ্ছি।

সমাবেশ থেকে ঘোষিত কর্মসূচিতে জানানো হয়-

১. বিদ্যুৎ-গ্যাস-নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, জাতীয় সম্পদ রক্ষা, পাচারের টাকা খেলাপি ঋণ উদ্ধার, রেশনিং ও ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলার দাবিতে ২৮-২৯ জানুয়ারি ২০২৩ দেশের সকল জেলা-উপজেলায় সমাবেশ-বিক্ষোভ।

২.ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ভোট ও ভাতের দাবিতে বিভাগীয় সদর জেলা-উপজেলায় সমাবেশ-পদযাত্রা।

৩. ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ থেকে দেশব্যাপী গণজাগরণ অভিযাত্রা, ঝটিকা সফর অনুষ্ঠিত হবে।

৪. ৬ মার্চ ২০২৩ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ৭৫তম বার্ষিকীতে মাসব্যাপী নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণের কথাও জানানো হয়।

সমাবেশে বলা হয়, ফেব্রুয়ারি মাসে গণজাগরণ অভিযাত্রা কর্মসূচি অন্যান্য বামপন্থিদের নিয়ে সংগঠিত করা হবে। ঐ ধারায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ অভিযাত্রা কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বামপন্থিরা ক্ষমতায় গেলে কীভাবে সংকট সমাধান করে সাধারণ মানুষের স্বার্থসহ দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে, সেসব কথাও সিপিবির ২০ জানুয়ারির সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে।

বর্তমান সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তার চটজলদি সমাধান নেই। এজন্য চলমান দুঃশাসন হটিয়ে, ব্যবস্থা বদল করতে হবে। এসময় ঘাপটি মেরে থাকা অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নানা সুবিধা নিতে তৎপর থাকবে। এসব বিষয়ে সচেতন থেকে মানুষকে নিজস্ব দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করে দুঃশাসন হটানোর সংগ্রামে সম্পৃক্ত করতে হবে। দ্বি-দলীয় ধারা বহাল রেখে বা ওলট-পালট করে মানুষের মুক্তি আসবে না

আজ তাই অন্যতম কাজ হলো, দ্বি-দলীয় রাজনীতির ফাঁদ থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করে বামপন্থিদের বিকল্প শক্তি সমাবেশ বাড়াতে মানুষকে সংগঠিত করা, সচেতন করা।

আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনকে পরাজিত করে ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম অগ্রসর করতে হবে। এজন্য সারাদেশের সিপিবি ও বামপন্থি নেতাকর্মীরা যেভাবে পথ চলেছেন তার থেকে কদম বাড়াতে হবে, সংগ্রাম বেগবান করতে হবে। দেশকে দুঃশাসন থেকে মুক্ত করতে ভোট ও ভাতের অধিকার আদায় করতে হবে। মেহনতি মানুষের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অগ্রসর করতে হবে।

২০ জানুয়ারি থেকে উচ্চারিত হয়, “বামপন্থিরা ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়বে, মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।” এটাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে, মানুষের আস্থা অর্জনে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।

শেয়ার করুনঃ