নব্বইয়ের ১০ দফার সঙ্গে সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে

ছাত্র-জনতার এক দশকের সংগ্রামে ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের পতন ঘটে। ৮৩-র মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রক্তস্নাত প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ৯০-এর ছাত্র-জনতার বিজয়ী গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার যবনিকাপাত ঘটে। ছাত্রদের ১০ দফা দাবির সঙ্গে নব্বই-উত্তর ক্ষমতাসীন দলগুলো বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গায়েব করে দিয়েছে এক দশকের সংগ্রামের অর্জনকে।

আশির দশকে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও এডিবির পরামর্শে অর্থনীতির একটা ব্যাপক কাঠামোগত সংস্কারের জন্য তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সামরিক শাসনের। জোর করে ক্ষমতা দখল, জুলুম-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা ও সম্পত্তি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে নামমাত্র মূল্যে তুলে দেওয়া হয় এই সময়। আশির দশক ছিল লুটপাট ও রাষ্ট্রের সহযোগিতায় ব্যাপক সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার ও লুম্পেন ধনিক শ্রেণি গঠনের কাল।

আশির দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন বিজয়ী হলেও সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবিদাওয়া পূরণ করেনি শাসক শ্রেণি। একে কেবলই ক্ষমতারোহনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছে তারা। দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর আগে ১৯৮৩ সালে প্রথমবার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রচনা করেছিল ১০ দফা।

সবশেষ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ১৯৯১ সালে ১০ দফা তৈরি করার মধ্য দিয়ে জোটের বিলুপ্তি ঘোষণা করে। ছাত্রদের ১০ দফা ছিল ব্যাপক। সমাজ, অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদসহ সামগ্রিক বিষয়ে ১০ দফার একটা সুস্পষ্ট অবস্থান ও নির্দেশনা ছিল। ছাত্ররা তাদের সংগ্রামকে কেবল নির্বাচনের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে ফেলতে চায়নি, তারা চেয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তর।

এরশাদের পতনের পর পালাক্রমে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করলেও ১০ দফার তেমন কিছুই বাস্তবায়ন করেনি তারা।
শিক্ষা বিষয়ে ১০ দফার প্রধান দাবি ছিল একটি সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক একই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা। উল্টোভাবে দেশে বহুধারার শিক্ষাব্যবস্থা এবং ধর্মভিত্তিক শিক্ষার আরও বিস্তার হয়েছে। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার মাদ্রাসা এবং উপজেলা পর্যন্ত বিকাশ ঘটেছে কিন্ডারগার্টেনের।

সাধারণ শিক্ষার প্রাইমারি স্কুল কেবল গরিবদের জন্য নিম্নমানের শিক্ষায়তন হিসেবে পড়ে আছে। ছাত্রদের দাবি ছিল শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ করা চলবে না, কিন্তু উল্টোভাবে মুদিদোকানের মতো নিম্নমানের শত শত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ছাত্রদের দাবি ছিল, শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হবে মাতৃভাষা, অথচ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলার পাশাপাশি চালু হয়েছে ইংরেজি সংস্করণ। নিজ দেশে বাংলা এখন অপাঙেক্তয় ভাষা।

ছাত্রদের দাবি ছিল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হলেও ধর্মান্ধতা প্রসারের যাবতীয় আয়োজন করা হচ্ছে। সব উপজেলায় আরও ধর্মীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ধর্ম নিয়ে খেলার ক্ষেত্রে বিএনপি-জামাত-হেফাজতের চেয়ে কম যায় না আওয়ামী লীগ।

আমরা দাবি করেছিলাম ১৯৮২ সাল থেকে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে এবং শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা ও মর্যাদা প্রদান করতে হবে, কিন্তু তা করা হয়নি। দাবি ছিল, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব হত্যার বিচার ও দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেনি। বরং রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতিবাজদের নিজেদের দলে আশ্রয় দিয়েছে। এমনকি জাতীয় পার্টির সঙ্গে ক্ষমতাসীনেরা মহাজোট গঠন করেছে।

ছাত্রদের ১০ দফায় একটা পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং বাক্-ব্যক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার রক্ষার দাবি ছিল। বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করতে বলা হয়েছিল। এর কিছুই হয়নি বরং বিচার বিভাগকে প্রশাসন ও সরকারের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। কালোটাকাওয়ালাদের অবাধে টেলিভিশন চ্যানেল ও ব্যাংক খোলার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

ছাত্রদের দাবি ছিল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হলেও ধর্মান্ধতা প্রসারের যাবতীয় আয়োজন করা হচ্ছে। সব উপজেলায় আরও ধর্মীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ধর্ম নিয়ে খেলার ক্ষেত্রে বিএনপি-জামাত-হেফাজতের চেয়ে কম যায় না আওয়ামী লীগ। আমরা বলেছিলাম রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা রাখতে হবে। এরশাদ প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করেনি তারা। যা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক চরিত্রকে নস্যাৎ করেছে।

শেয়ার করুনঃ