নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৯-২০২২)-এর সময়সীমা বাড়ানো, অতিসত্বর পরিপত্র জারি করা, বার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্তি ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
আজ ২৬ জুলাই, ২০২২ তারিখে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ইউএনওমেন-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস)-এর উদ্যোগে নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৯-২০২২)-এর বাস্তবায়ন বিষয়ক জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপিএস-এর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীরের সভানেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ইউএনওমেন-এর ডেপুটি ক্লান্ট্রি রিপ্রেজেন্টটেটিভ দিয়া নন্দা, বাংলাদেশের অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার নার্দিয়া সিম্পসন। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন। উক্ত সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব ফজিলাতুননেছা ইন্দিরা, এমপি। উক্ত সংলাপে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ইউএনওমেন-এর প্ল্যানিং, মনিটরিং অ্যান্ড রিপোর্টিং অ্যানালিস্ট তানিয়া শারমীন। প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন রিব-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ শিপা হাফিজা ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিমা মোসলেম। উক্ত সংলাপে আরও বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এর উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আমেনা বেগম, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাইসা ইসলাম প্রমুখ। উক্ত সংলাপে পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (ইউএন) তৌফিক ইসলাম সাতিল উপস্থিত ছিলেন।
সভাপ্রধানের বক্তব্যে রোকেয়া কবীর বলেন-বাংলাদেশ বর্তমানে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নাই কিন্তু এই স্বাধীন বাংলাদেশে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীসমাজ বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার। এই বৈষম্য, সহিংসতা ও দ্ব›দ্বময় পরিস্থিতির মূলে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ, জনমনে গণতন্ত্র সম্পর্কে একপেশে ধারণা ও চর্চা এবং নারীবিদ্বেষী প্রচার-প্রচারণা-যা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৯-২০২২)-বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় এসব মূল কারণগুলিতেই কাজ করা প্রয়োজন। অ্যাকশন প্ল্যানের কর্মসূচিসমূহ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার আওতাভুক্তকরণ এবং সে অনুযায়ী জাতীয় বাজেটেও আওতাভুক্তকরণের জন্য অতিসত্ত¡র পরিপত্র জারি করা প্রয়োজন।
ইউএনওমেন-এর প্লানিং,মনিটরিং অ্যান্ড রিপোর্টিং আনালিস্ট তানিয়া শারমীন তাাঁর কিনোট পেজেন্টেশনে ন্যাশন্যাল প্লান –উইমেন পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন। সিভিষ সোসাইটি সংস্থা ও বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রিদের সাথে উইমেন পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেন তিনি।
ইউএনওমেন-এর ডেপুটি ক্লান্ট্রি রিপ্রেজেন্টটেটিভ দিয়া নন্দা বলেন- আজকের আলোচনায় টঘঝঈজ ১৩২৫ এজেন্ডা বাস্তবায়নে সিভিল সোসাইটি সমাজের সম্পৃক্ততার গুরুত্ব লক্ষণীয়। আমরা আশা করি যে, এই আলোচনা, ঘঅচ ডচঝ-এ বর্ণিত সিভিল সোসাইটি সংস্থাদের জন্য পরামর্শমূলক এই প্ল্যাাটফর্মকে আনুষ্ঠানিক করার প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিবে।
অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাই কমিশনার নার্দিয়া সিম্পসন বলেন, ইউএন পিস কিপিং মিশনে বাংলাদেশ রোল মডেল। ইউএন পিস কিপিং মিশনে বাংলাদেশ থেকে ১ লক্ষ ৮০ হাজার পিস কিপিংয়ের দায়িত্ব পালন করছেন যার মধ্যে ২, ৩০০ জন নারী। বাংলাদেশ নারীরা বিশে^র শান্তি রক্ষায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছেন। তবে, পিস কিপিং মিশনের মাধ্যমে শান্তি রক্ষায় যথেষ্ট নয়। নারী, শান্তি ও নিরাপত্তায় যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে এতে আন্তর্জাতিক, জাতীয়, স্থানীয় ও ব্যক্তি পর্যায়ে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তাই নারী, শান্তি ও নিরাপত্তায় এজেন্ডায় সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের ভূমিকা অপরিসীম।
রিব-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, নারী, শান্তি ও নিরাপত্তায় যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে এটি প্রণয়নের সঙ্গে শুরু থেকে জড়িত ছিলাম। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এর বাস্তবায়নে জড়িত থাকলেও নারীর শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে যে সামাজিক যে বিষয়গুলো যুক্ত, তা চিহ্নিত করে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিভিল সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নারী, শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মৌলবাদ মোকাবিলা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, দ্ব›দ্ব ও সংঘাত প্রতিরোধ এই বিষয়গুলোর ওপর আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি। তাই রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন-প্রতিরোধও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ শিপা হাফিজা বলেন, উইমেন পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি শুধুমাত্র নারীর শান্তি বা নারীর নিরাপত্তা না, এটি সার্বিকভাবে একটি সমাজের সব মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। যেভাবে নারীরা নির্যাতন, নিপীড়ন, অবমাননার শিকার হয়, তার ফলে সমাজে বৈষম্য ও অনিরপত্তা বিরাজ করে। নারীর শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ একটি শান্তির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। এই জাতীয় কর্মপরিকল্পনা যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তবে তা আমাদেও সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা নিরসনে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষর্দে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, আমরা নারী-পুরুষের সমতার কথা বলি কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? নারী-পুরুষের সমতা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় জীবনে বা কাগজে-কলমে। ব্যক্তি জীবনে নারী-পুরুষের সমতা নেই। বিবাহ বিচ্ছেদে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে, সন্তানের অভিভাবকত্বে, ব্যক্তি অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা নেই। নারীর জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলে ব্যক্তি জীবনে নারীর প্রতি এসব বৈষম্যের নিরসন করতে হবে।
বিশেষ অতিথি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন-এই জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৯-২০২২) বাস্তবায়নে সমন্বয় সাধনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সমন্বয় গ্রæপ গঠন করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হবে এবং পাশাপাশি সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, নারী সংগঠন, শিক্ষাবিদ ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি ও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর প্ল্যাটফরম্ গঠন করা হবে যারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে অগ্রসর করে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া তিন (২০১৯-২০২২) বছরের জন্য প্রণীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনার তৃতীয় বছর চলছে কিন্তু করোনাকালীন বাস্তবতার কারণে যে মাত্রায় অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, সে মাত্রায় সম্ভবপর হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে পরিকল্পনার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। অ্যাকশন প্ল্যানের কর্মসূচিসমূহ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার আওতাভুক্ত হবে অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত আওতা নির্ধারিত হবে এবং সে অনুযায়ী জাতীয় বাজেটেও আওতাভুক্ত হওয়ার কথা।
প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব ফজিলাতুননেছা ইন্দিরা, এমপি বলেন-নারীর শান্তি ও সুরক্ষার বিষয়গুলো আমাদের জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালায় আছে। তবে এই নীতিমালায় সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য ও কাজের কথা বলা আছে, যা যে কোনো সংঘাতময় ও দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে নারীর চাহিদা, নারীর নিরাপত্তা এবং নারীর অংশগ্রহণের পথকে সুনিশ্চিত করবে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিসহ নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নানাবিধ কর্মপরিকল্পনা মাল্টি-সেক্টোরাল প্রজেক্টের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে। আমি আশাবাদ ব্যক্ত করি, বিদ্যমান এ সকল কাজের সমন্বয় করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তার দায়িত্ব পালন করবে এবং সর্ব্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।
এ ছাড়া বক্তারা আরও বলেন- যে কোনো হিউম্যানিটারিয়ান পরিস্থিতিতে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সেবাদানকারীদের জেন্ডার ও মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দিতে হবে, নারীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বন্ধ করতে হবে, সাইবার ক্রাইম বন্ধ করতে হবে এবং নারীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ আইন ও নীতি বাতিল করতে হবে এবং ধর্মভিত্তিক উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করতে হবে।মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।