২৪ এপ্রিল, রবিবার, সকাল ১০ টায় রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যার ৯ বছরে ৪ দিন ব্যাপী কর্মসূচিতে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি সাভার রানা প্লাজার সামনে ‘‘ মৃতুদের স্মরণ করো জীবিতদের জন্য লড়াই করো’’ ¯শ্লোগানে প্রতিবাদ র্যালী করে। র্যালীতে নিহত পরিবারের স্বজন, আহত শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমিকরা উপস্থিত হয়।
মিছিলে প্লাকার্ডে আমরা তোমাদের ভুলবো না, দোষীদের ছাড়বো না, সকল তরুণ শ্রমিকদের রক্ষায় এক হও, আর কোন রানা প্লাজা চাই না, দ্রব্য মূল্য কমাও মজুরি বাড়াও ইত্যাদি শ্লোগানে দেখা যায়। নেতৃবৃন্দ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির ব্যানারে মিছিলসহ স্বজন ও আহতদের সাথে একসাথে রানা প্লাজায় প্রাণ হারানো ১১৭৫ জনেরও বেশী শ্রমিকের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করে এক মিনিট নীরবতা পালন করে। শ্রদ্ধা শেষে রানা প্লাজার সামনে তারা একটি প্রতিবাদ সভা করে।
এই সভা শেষে নেতৃবৃন্দ ও স্বজন ও আহতদেও একটি দল উদ্ধারকর্মী নওশাদ হোসেন হিমু ওরফে হিমালয় হিমুর আত্মাহুতির স্থান বিরুলিয়া গোলাপ বাগানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এই সভাদুটিতে বক্তব্য রাখেন, সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার, সাধারণ সম্পদক জুলহাস নাইন বাবু, নিহত আঁখি আক্তারের মা নাছিমা আক্তার এবং আহত শ্রমিক রুপালী আক্তার। এছাড়া আশুলিয়া শাখার সভা প্রধান বাবুল হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক জিয়াদুল ইসলামু উপস্থিত ছিলেন।
স্বজনরা বলেন, আপনজন হারানোর যন্ত্রনা লাখো টাকায় পুরণ হবার না। প্রত্যেকের কাছে তাঁদের স্বজন -আপনজন মূল্যবান। রানা প্লাজায় নিহত হওয়া হাজারো প্রাণহানীর মধ্য দিয়ে তাদের স্বপ্ন চুরমাচুর হয়েছে, হারিয়েছে আপনজন। উপার্জনক্ষম সদস্য না থাকায় পরিবারে নেমে এসেছে বিপর্যয়। একইসাথে তারা বলেন, অনেক আহত শ্রমিক এখনো অসুস্থ আছে, কেউ কেউ মানসিক যন্ত্রণার থেকে রেহাই পায়নি। রানা প্লাজার দু:সহ স্মৃতি তাঁদের তারা করে বেড়াচ্ছে ।
রানা প্লাজার ৬ বছরের সময় সাহসী উদ্ধারকর্মী হিমালয় হিমু নিজ গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে। তাকেও সেই স্মৃতি তাড়া করে বেড়াতো। তারা অবিলম্বে দোষীদের শাস্তি ও ক্ষতিপুরণের আইন বাতিলের দাবি জানান। একইসাথে রানা প্লাজার সামনে স্থায়ী স্মৃতি স্তম্ভ এবং স্মৃতি স্থান হিসাবে তৈরীরর আহবান জানান। তারা বলেন এখানে রানা প্লাজার ভবনের সামনে জায়গা দখলের নানা পাঁয়তারা চলছে। এই জায়গা দখল মুক্ত করারও আহবান জানান তারা।
সংগঠনের সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার ও অন্যান্য নেতৃত্ব বলেন, রানা প্লাজার হাজারো প্রান হত্যার ৯ বছর পার হয়েছে। এখনো সেই দু:সহ স্মৃতি শ্রমিক এবং স্বজনরা বয়ে বেড়াচ্ছে। মালিক সরকার এবং বায়ার এই ৩ পক্ষই চায় রানা প্লাজার দু:সহ স্মৃতি মুছে ফেলতে। কিন্তু রানা প্লাজার শ্রমিকদের বাংলাদেশের বর্তমান শ্রমিক এবং শ্রমিক সংগঠন কখনো ভুলতে পারবে না। এই স্মৃতি বাঁচিয়ে এর থেকে শক্তি নিয়ে মৃতদের স্মরণ করে এবং জীবিতদের জন্য লড়াই করতে হবে।
তারো আরো বলেন ৯ বছরেও ক্ষতিপুরণের আইন বদল হয়নি এবং দোষীর শাস্তি হয়নি। দোষীদের শাস্তি না হওয়াকে সরকার এবং মালিকের সদিচ্ছার অভাবের প্রতিফলন হিসাবে তারা চিহ্নিত করেন। ভবন ফাঁটল এবং ১১৭৫ জনেরও বেশী শ্রমিকের প্রাণহানীকে অবকাঠামোগত হত্যাকান্ড বলে তারা চিহ্নিত করেন। তারা বলেন, এই কারখানার অনুমোদ কিভাবে হলো, এর ডিজাইনে কী কী ত্রুটি ছিল, কারখানা অধিদফতরের পরিদর্শনের কোথায় ত্রুটি ছিলো এই সমস্ত বিষয়গুলো জোরের সাথে সামনে আনতে হবে। সরকার , মালিক এবং বায়ার ৩ পক্ষেরই দায় আছে এই শ্রমিক হত্যায়। তাদেও দায়কে জোরের সাথে সামনে হাজির করতে হবে। তারা অবিলম্বে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও ক্ষতিপুরণের আইন বদলের দাবি করেন। তারা বলেন, নিহত পরিবারের স্বজন এবং পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকদের এক জীবনেরক্ষতিপুরণ দিতে হবে। সকল আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার দায়ভার সরকারের পাশাপশি অবশ্যই মালিক, বিজিএমই বায়ারকে নিতে হবে।
তারা আরো বলেন, দোষীদের শাস্তি বা বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় এবং ক্ষতিপুরণের আইন বদল না হওয়ায় এখ পর্যন্ত সকল কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের অবহেলা করে। তাদের মধ্যে কোন সতর্ক বার্তা পৌঁছায়নি। বরং এই বিচারহীনতা এবং ক্ষতিপুরণ বদল না হওয়ায় মালিক বায়ার সরকার ৩ পক্ষই শ্রমিকের শ্রমকে অদৃশ্য করার চেষ।টা করে। একই সাথে আমাদের মালিক এং সরকার শ্রমিকদের মানুষের দৃষ্টিতে যে বিচার করে না তাই প্রকাশ পায়। তারা অবিলম্বে ক্ষতিপুরণের আইন বাতিল এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও দোষীদেও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান।
তারা আরো বলেন নিরাপত্তা কেবল ভবনের সাথেই জড়িত বিষয় নয়। রানা প্লাজার সস্তা শ্রমিকরা মাসের শেষে বেতন না পাওয়া, হাজিরা বোনাস কাটা যাওয়া, ওভার টাইম না থাকা ইত্যাদি ভয় থেকেই ২৪ এপ্রিল ২০১৩ তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজে গিয়েছিলো। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪ লাখ পোশাক শ্রমিকরা ৮০০০ হাজার টাকার বেতনে দুবিষহ জীবন যাপন করছে। শ্রমিক সংগঠনরা ২০ হাজার টাকা দাবি করেছে। নেতৃত্ব বলেন শ্রমিকের নিরাপত্তা বিধানে বেতন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
বিরুলিয়ায় হিমুর আত্মাহুতির স্থানে শ্রদ্ধা:
রানা প্লাজার কর্মসূচি শেষে নেতা কর্মী এবং স্বজনদের দল একসাথে বিরুলিয়া গোলাপ বাগানে হিমুর আত্মাহুতির স্থানে যান। সেখানে শ্রদ্ধা জানান এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করে। নীরবতা শেষে হিমু স্মরণে তারা স্মৃতিচারণ করেন। তাঁরা বলেন, হিমু রানা প্লাজার সাহসী উদ্ধাকর্মী এবং তরুণদের প্রতিনিধি ছিলো। যে একইসাথে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হয়েও শ্রমিকদের পাশে ছিলো। রানা প্লাজা ধসের ১৭ দিন গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি এবং ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ উদ্ধারকর্মে হিমু সাহসী পদক্ষেপ রাখেন। তারা বলেন, হিমু রানা প্লাজার ভেতর থেকে মরা গলা লাশ যেমন সাহসের সাথে বের করেছিলো তেমনি অনেকের হাত পা কেটেও এনেছিলেন। তারপর সেই দু:সহ স্মৃতি তাকে তাড়া করেছে সবসময়। একইসাথে সমাজের নানা অসঙ্গতিতে ক্ষুব্ধ হিমু ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার ৬ বছর পুর্তিতে নিজ শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। নেতৃবৃন্দ বলেন, হিমুর স্মৃতি ধরে রাখতে হবে। এবং বাংলাদেশে আর কোন হিমু যাতে আত্মাহুতি দিতে না হয় সেজন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা এবং এই বৈষম্য -অসঙ্গতির সমাজ পরিবর্তনে শ্রমিক-ছাত্র-নারী এক সাথে পাশে দাড়িয়ে লড়াই করার আহবান জানান তারা।