বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশের চাপ সামলাতে অনেক বড় কোম্পানি ঠিকায় কাজ করাচ্ছে।
গাজীপুরে হঠাৎ নতুন তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনের ধুম পড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে ঢাকার পাশের এই জেলায় অন্তত ৫০টি নতুন কারখানা গড়ে উঠেছে। করোনার কারণে ২০২০ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ৭টি কারখানাও আবার চালু হয়েছে। কারখানাগুলোর অধিকাংশই সাবকন্ট্রাক্টে (ঠিকায় কাজ) পোশাক তৈরি করছে।
এক মাসে অর্ধশত কারখানা স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে গাজীপুর শিল্প পুলিশ। তারা বলছে, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নতুন ৫৭টি পোশাকসহ অন্যান্য খাতের কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অন্তত একটি দপ্তর থেকে যেসব কারখানা লাইসেন্স নিয়েছে, শুধু তাদের তালিকা নেওয়া হয়েছে। সরকারের কোনো দপ্তর থেকে লাইসেন্স নেয়নি এমন কারখানাও আছে বেশ কিছু। ফলে প্রকৃতপক্ষে নতুন কারখানার সংখ্যা এক শর কাছাকাছি হতে পারে।
পোশাক খাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার শুরু হওয়ায় হঠাৎ পোশাকের ক্রয়াদেশ বেড়ে গেছে। কোনো কোনো কারখানা উৎপাদন সক্ষমতার বেশি ক্রয়াদেশ নিয়ে ফেলেছে। সেই ক্রয়াদেশের পণ্য সময়মতো সরবরাহ করার জন্যই অনেক প্রতিষ্ঠান ঠিকায় কাজ দিয়ে পোশাক তৈরি করছে। এ কারণে গাজীপুরে কারখানা স্থাপনের সংখ্যা হঠাৎ বেড়েছে।
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নতুন স্থাপিত ৫৭ কারখানার মধ্যে ১০টি তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য।
গত মাসে সরেজমিনে গাজীপুরের নতুন কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা যায়, এসব কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়েছে। কোনো কোনোটিতে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নেই। ১৮ বছরের কম বয়সী অনেক শ্রমিকও কাজ করছেন এসব কারখানায়। অনেক কারখানায় শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির বিষয়টিও মানা হচ্ছে না।
সাত বছর আগে সরকার একটি সাবকন্ট্রাক্ট নীতিমালার অনুমোদন দিয়েছিল। সে নীতিমালায় বলা আছে, সাবকন্ট্রাক্টের কাজে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে। গ্রুপ বিমা থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে কারখানার নকশা অনুমোদন এবং কারখানায় কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু নতুন চালু হওয়া কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে সাবকন্ট্রাক্ট নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে না।
গাজীপুরের বোর্ডবাজারে কলমেশ্বর এলাকার একটি দোতলা ভবনের ওপর তলা ভাড়া নিয়ে কাজ করছে লাবিব নিট ফ্যাশন নামের একটি কারখানা। এতে শতাধিক শ্রমিক গাদাগাদি করে কাজ করেন।
কারখানাটির সমন্বয়ক আরিফুল ইসলাম জানান, তাঁরা সাবকন্ট্রাক্টে মেয়েদের স্কার্ট, করোনা প্রতিরোধক মাস্ক, টি-শার্ট ও ট্রাউজার তৈরি করেন। একজন শ্রমিক জানান, দুটি বড় কারখানার কাজ সাবকন্ট্রাক্টে করছেন তাঁরা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো পাশের একটি সাততলা ভবনে গত ১৮ জানুয়ারি আরএমজি ফ্যাশন নামে নতুন একটি কারখানা চালু হয়েছে। এই কারখানায়ও শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন, যাঁদের মজুরি ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। সরেজমিনে কারখানাটির ভেতরে কোনো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দেখা যায়নি। ভবনটিও বেশ পুরোনো। বিকল্প সিঁড়িও নেই।
কারখানাটির শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কারখানাও চলছে ঠিকায় কাজ করে। শুরুতে শীর্ষস্থানীয় এক পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য সাত লাখ মাস্ক তৈরি করে দেয়। এরপর আরেকটি বড় গ্রুপের ট্রাউজার ও প্যান্ট বানিয়েছে। এখন ডেলটা ফ্যাশনের থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট তৈরির কাজ চলছে।
আরএমজি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক রুমা কাজী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠার মাত্র এক মাসের মধ্যে কারখানায় কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ জন্য অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। কাজের কোনো অভাব নেই।
আরএমজি ফ্যাশনের একই ভবনের পঞ্চম তলায় রাজবাড়ি গার্মেন্টস। সেখানেও অল্প জায়গায় কাজ করছেন ১৩০ জন শ্রমিক। কারখানাটিরও কর্মপরিবেশ এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল।
জানতে চাইলে রাজবাড়ি গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাজু আহমেদ বলেন, কারখানার উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে কিছুটা সময় লাগবে। লাইসেন্স পেতে দেরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
শিল্প পুলিশ জানায়, গাজীপুর জেলায় মোট কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৬৫। এর মধ্যে পোশাক কারখানা ১ হাজার ১৮৭টি। পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্যসংখ্যা যথাক্রমে ৭৭১ ও ১৩০। বাকি ৯৭৮টি অন্যান্য খাতের কারখানা। তবে লাইসেন্সবিহীন কারখানার সংখ্যাও কম নয়। সব মিলিয়ে গাজীপুরে পাঁচ হাজারের মতো ছোট-বড় কারখানা রয়েছে।
শিল্প পুলিশের গাজীপুরের পুলিশ সুপার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, হঠাৎ কারখানা নির্মাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এসব কারখানার নির্মাণ পরিকল্পনায়ও ঘাটতি আছে। কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানো কঠিন হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ক্রয়াদেশ বাড়ছে বলে কর্মপরিবেশের সঙ্গে আপস করে কারখানা স্থাপন করা ঠিক যাবে না। কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করেই কারখানা পরিচালিত হতে হবে। ঠিকা কাজে যেসব কারখানা চলছে, সেগুলো নিয়মিত নজরদারির মধ্যে রাখার দায়িত্ব ক্রেতা, বিজিএমইএ ও সরকারের।