শ্রমিকের মজুরি কম কিন্তু ব্যয় বেশি। এ জন্য তাঁদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে

টিনের ঘরে ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকেন বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। কক্ষ ভাড়া পড়ে তিন হাজার টাকা। এক কক্ষে একটি পরিবারের চার থেকে পাঁচ সদস্যের বসবাস। সম্প্রতি গাজীপুর সদরের লক্ষ্মীপুরা এলাকায় ছবি: প্রথম আলো

শিল্পের শহরে শ্রমিকের দুর্বিষহ জীবন

কাজের অভাব নেই। কিন্তু মাস শেষে একজন শ্রমিক যে টাকা মজুরি পান, তা দিয়ে সংসার চলে না।

জোছনা খাতুনের বিয়ের বয়স যখন ৮ বছর, তখন হঠাৎ করেই তাঁর স্বামী মারা যান। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির মৃত্যুর পর দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে হঠাৎ বিপর্যয়ে পড়েন তিনি। এ অবস্থায় আবারও বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু জোছনা খাতুন তিন সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পণ করেন। তাই সিরাজগঞ্জের নিজ বাড়ি থেকে চলে আসেন গাজীপুরের জয়দেবপুরে। ওঠেন এক ভাড়া বাসায়। এক যুগ আগে শুরু হওয়া সেই জীবনসংগ্রামে এখনো লড়ে যাচ্ছেন জোছনা।

জীবিকার প্রয়োজনে গাজীপুরে এসে কাজ নেন এক পোশাক কারখানায়। কিন্তু একটি দুর্ঘটনার পর আর কাজে যাওয়া হয়নি তাঁর। গাজীপুরের জয়দেবপুরের লক্ষ্মীপুরা এলাকায় এক রুমের একটি খুপরিতে ভাড়া থাকেন জোছনা খাতুন। মাসে ভাড়া তিন হাজার টাকা। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে কাজ করেন স্টাইলক্রাফট নামের একটি পোশাক কারখানায়। মজুরি পান ১৪ হাজার টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামছাড়া খরচে ছেলের মজুরি দিয়ে তিনজনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে।

১৯ ফেব্রুয়ারি জোছনার সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে গরুর মাংসের কেজি কত জানতে চাইলে একগাল হেসে তিনি বলেন, ‘জানি না। শুধু এতটুকু মনে আছে, সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদে ছেলে দুই কেজি মাংস কিনে এনেছিল। তারপর আর পাতে পড়েনি। করোনার কারণে আর্থিক সংকটে পড়ায় ১০ মাসের বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে। সামনে ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা।’ এ অবস্থায় জীবনসংগ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে জোছনার শেষ বাক্যটি ছিল, ‘ওপরে আল্লাহ, নিচে আমি, সামনে অজানা ভবিষ্যৎ’।

জোছনা খাতুনের মতো কয়েক লাখ শ্রমিক তাঁদের পরিবার নিয়ে আর্থিক সচ্ছলতার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে ছুটে এসেছেন শিল্পের শহর গাজীপুরে। সরেজমিনে কয়েক দিনে বেশ কয়েকটি পেশার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে স্বপ্ন নিয়ে শিল্পের শহরে তাঁরা ছুটে এসেছেন, তা স্বপ্নই রয়ে গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, কোনোমতে খেয়ে–পরে দিন কাটছে তাঁদের। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে বছর পেরিয়ে যায়।

একসময় কৃষিপ্রধান জেলা হিসেবে পরিচিতি ছিল গাজীপুরের। দিন দিন ঢাকার পাশের জেলাটি রূপ পেয়েছে শিল্পের জেলা হিসেবে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, কর্মসংস্থানে শীর্ষে থাকা দেশের পাঁচটি জেলার মধ্যে গাজীপুরের অবস্থান দ্বিতীয়। ঢাকার (৩৬ শতাংশ) পরেই মোট কর্মসংস্থানের ১৭ শতাংশ হয়েছে গাজীপুরে। গাজীপুর শিল্প–পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় ছোট–বড় পাঁচ হাজার কারখানা রয়েছে। যেখানে কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ করেন। শুধু পোশাক কারখানাই নয়, ওষুধ, আসবাবসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমিক কাজ করেন সেখানে। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুরে ২৫ লাখ মানুষের বসবাস। যদিও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পাঁচ উপজেলা মিলে গাজীপুরের জনসংখ্যা এখন ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

জীবনের একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যাঁরা গাজীপুরে এসেছেন, তাঁরা কেমন আছেন? কেমনে কাটছে এ জেলায় কর্মরত বিভিন্ন পেশার শ্রমিকের দিনকাল? তা জানতে ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় বেশ কয়েকটি পেশার শ্রমিকের।

তাঁদেরই একজন শহীদ মিয়া। বাড়ি ময়মনসিংহে। এক দশক আগে পরিবার নিয়ে আসেন গাজীপুরের শিববাড়ীতে। নিজে অটোরিকশা চালান। স্ত্রী বিলকিস আক্তার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। দুই ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে ১০ ফুট বাই ১৫ ফুটের একটি ছোট্ট রুমে ভাড়ায় থাকেন। এক রুমের মাসে ভাড়া ৩ হাজার ২০০ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে খাটে ঘুমান। আর সন্তানেরা ঘুমান মেঝেতে। শহীদ মিয়া বলেন, ‘বাড়িতে মা–বাবা দুজনই অসুস্থ। তাঁদের চিকিৎসার জন্য মাসে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে হয়। টানাটানির সংসার। দুই রুমের বাসা ভাড়া নেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা নেই। স্বামী-স্ত্রী মিলে যা আয় করি, তা চলে যায় বাসাভাড়া, বাজার খরচ ও বাড়িতে মা–বাবার চিকিৎসা খরচে। মাস শেষে সঞ্চয় করার কিছু থাকে না।’

বিভিন্ন সামাজিক সূচকে গাজীপুর যে অনেক পিছিয়ে, তা সরকারি জরিপেও উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার চেয়ে গাজীপুরে শিশুশ্রম বেশি। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুশ্রম গাজীপুরে ১০ শতাংশ। ঢাকায় সেখানে ৬ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হারও গাজীপুরে বেশি। এ জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার হার ৭৮ শতাংশ। ঢাকায় এ হার ৮৫ শতাংশ। গাজীপুরে মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখা শেষ করার হার ৫৫ শতাংশ, ঢাকায় যা ৬১ শতাংশ। গাজীপুরে সাক্ষরতার হার ৮০ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য বলছে, নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার ক্ষেত্রেও গাজীপুর অনেক পিছিয়ে। জেলার মাত্র ৪৮ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা রয়েছে।

ঢাকার পাশের জেলা হলেও গাজীপুরে নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের হারও ঢাকার তুলনায় কম। ঢাকায় নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ৩৬ শতাংশ, গাজীপুরে তা ১৭ শতাংশ। গাজীপুরের ২৪ শতাংশ নারী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন, ঢাকায় এ হার ২০ শতাংশ।

তবে সরকারি তথ্য বলছে, গাজীপুরে হতদরিদ্রের সংখ্যা কম। সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস ও যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এ জেলার মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।

স্থানীয় শ্রমিকনেতারা বলছেন, গাজীপুরে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা কম, এটা ঠিক। কারণ, এখানে কাজের সুযোগ বেশি। কিন্তু কাজ থাকলেও জীবনমানের উন্নতি হচ্ছে না। অর্থাভাবে বেশির ভাগ শ্রমিক পরিবার–সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারেন না। তাঁরা শুধু খেয়ে–পরে বেঁচে আছেন। ফলে শিল্পের জেলায় তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শ্রমিকনেতারা অভিযোগ করেন, অনেক কারখানা শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি দেয় না।

জীবন ও জীবিকার কষ্টের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের দুর্ভোগ। এক দশক ধরে চলতে থাকা এ প্রকল্পের কারণে গাজীপুরে ধুলাবালু বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। যার ফলে শ্রমিকদের নানা ধরনের অসুখ লেগেই আছে।

গাজীপুরের শ্রমিকনেতা আশরাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, একজনের মজুরি দিয়ে গাজীপুরে টিকে থাকা কঠিন। তাই অনেক পরিবারে এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করছেন। তা সত্ত্বেও নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি এখানকার শ্রমিকের জীবনসংগ্রাম আরও কঠিন করে দিয়েছে।

গাজীপুরের সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে যাঁরা শুধু শ্রমের ওপর নির্ভরশীল, তাঁরা বেশ কষ্টে আছেন। তাই জীবিকার তাগিদে অনেক শ্রমিক দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। ফলে গাজীপুরে শ্রমিকসংকট চলছে। তিনি বলেন, শ্রমিকের মজুরি কম। কিন্তু ব্যয় বেশি। এ জন্য তাঁদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে শ্রমিকেরা খুব একটা ভালো নেই।

(আরিফুর রহমান, মাসুদ রানা, গাজীপুর, প্রথম আলো প্রতিবেদনঃ প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২০: ০২)

শেয়ার করুনঃ