জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমার ৮০তম জন্মবার্ষিকী আজ

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমার ৮০তম জন্মবার্ষিকী আজ সোমবার। সন্তু লারমার জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট মৌজার মহাপুরম গ্রামে। দুই দশকের বেশি সময়ের সশস্ত্র লড়াই শেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তিনি জেএসএস প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি করেন। বরাবরের মতো অনাড়ম্বরভাবেই এদিন উদ্‌যাপিত হবে। তাঁর দল জনসংহতি সমিতিরও এ উপলক্ষে কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই।

সন্তু লারমার বাবার নাম চিত্ত কিশোর চাকমা, মা সুভাষিণী দেওয়ান। চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা, তারপর দুই ভাই শুভেন্দু প্রবাস লারমা ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সন্তু লারমা।

মহাপুরম জুনিয়র হাইস্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন সন্তু লারমা। রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৫৯ সালে। চট্টগ্রামের স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে তিনি ১৯৬১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৩ সালে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন। শিক্ষকতায় পেশাগত জীবন শুরু। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন মাইসছড়ি জুনিয়র হাইস্কুল, গুইমারা জুনিয়র হাইস্কুল ও দীঘিনালা হাইস্কুলে। চাকরিজীবনেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শিক্ষক সমিতি গঠন করেন এবং তিনি ছিলেন এর সভাপতি।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সন্তু লারমা। ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে পাহাড়ি ছাত্র সমিতি গঠনে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে সিএইচটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এর মাধ্যমেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইয়ে শামিল হন। ১৯৭৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পান ১৯৮০ সালের ২২ জানুয়ারি। সে বছরই জেএসএসের নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৮৩ সালে জেএসএসের সভাপতি হন সন্তু লারমা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৯২ সাল থেকে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দেন তিনি। পিসিজেএসএসের পক্ষে তিনি ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৯৯ সালের ১২ মে চুক্তির ফলে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হন তিনি। এখনো সেই পদে আছেন। এর পাশাপাশি ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতির দায়িত্বে আছেন।

সন্তু লারমা ১৯৬৪ সালে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী শিপ্রা দেওয়ান অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা। উজানা লারমা ও জুলিয়ানা লারমা নামের তাঁদের দুই মেয়ে আছেন।

বিশিষ্টজনদের শুভেচ্ছা

জেএসএসের সভাপতি সন্তু লারমার ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেছেন, সন্তু লারমা দেশপ্রেমিক ও মানবদরদি এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভাই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা দেশের প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে তাদের এক পরিচয় দিয়ে গেছেন। সন্তু লারমা সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। পার্বত্য চুক্তির পর ২৪ বছর চলে গেছে। তবু সন্তু লারমা শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, এ চুক্তির বেশ কিছু শর্ত এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু ২৪ বছর ধরে তিনি ধৈর্য ধরে এর বাস্তবায়নের সংগ্রামে আছেন। এটা একটি বড় ব্যাপার। তিনি নিম্নবিত্তের, দরিদ্র মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। সেই অর্থে তিনি মানবতাবাদী নেতা।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পাহাড়ের মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই শুরু করেছিলেন। সংগ্রামমুখর জীবনে তিনি জাতীয় পর্যায়ের নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন। তাঁর দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন কামনা করেন তিনি। আর পাহাড় ও সমতলের মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই তিনি চালিয়ে যাবেন, এ প্রত্যাশা থাকছে।

সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কাছে সন্তু লারমা পাহাড়ের এক অসাধারণ মানুষ। সেলিনা হোসেন বলেন, ‘তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই আর তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করি।’

সন্তু লারমাকে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল একজন সংগ্রামী মানুষ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি মানুষ তাঁর আত্মপরিচয় অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। সন্তু লারমা তাঁর জাতিসত্তার মানুষের পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আত্মপরিচয়ের জন্য, অস্তিত্বের জন্য, সংগ্রামের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর দীর্ঘ, সুস্থ জীবন কামনা করি।’

শেয়ার করুনঃ