যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত তিন বছরে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা বেড়েছে ২.৮৭ শতাংশ। বাংলাদেশের বেড়েছে ২.২৪ শতাংশ।
বাণিজ্যযুদ্ধ ও করোনার কারণে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারাচ্ছে চীনের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। সেই ব্যবসা পাচ্ছে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ। যদিও বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থান দখলের পাশাপাশি এখানেও বাংলাদেশকে পেছনে ফেলেছে ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীরা।
তিন বছর আগে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দেশ থেকে ৮ হাজার ২৮৮ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছিল। তার মধ্যে চীনের রপ্তানি ছিল ৩৩ শতাংশ বা ২ হাজার ৭৩৭ কোটি ডলারের। তারপর টানা দুই বছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তাদের পোশাক রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে যায়। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর ২০২০ সালে মহামারি করোনায় সবকিছু টালমাটাল হয়ে যায়।
করোনার মধ্যে গত বছর চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১ হাজার ৯৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। সেই হিসাবে, গত তিন বছরে চীন এই বাজারে ৭৭৬ কোটি ডলারের পোশাকের ব্যবসা হারিয়েছে। চীনের হারানো এই ব্যবসা অন্য প্রতিযোগীরা ভাগাভাগি করে দখল করেছে। কারণ, চীনের রপ্তানি কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা আমদানি সেভাবে কমায়নি। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ৮ হাজার ১৫৯ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, যা ২০১৮ সালের চেয়ে মাত্র ১২৯ কোটি ডলার কম।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এমন তথ্য মিলেছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ২০২০ সালের চেয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়িয়েছে।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে চীনের হারানো ব্যবসা বেশি পেয়েছে ভিয়েতনাম। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল ১ হাজার ২২২ কোটি ডলার। পরের বছর সেটি বাড়ে ১৩৪ কোটি ডলার। তবে করোনার আবার কমে যায়। সর্বশেষ গত বছর তারা রপ্তানি করে ১ হাজার ৪৩৭ কোটি ডলারের পোশাক। সব মিলিয়ে গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দেশটির পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২১৫ কোটি ডলারের।
তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। তার বিপরীতে বাংলাদেশের বাজার হিস্যা বেড়েছে ২ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ছিল ৫৪০ কোটি ডলারের। ২০১৯ সালে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এ কারণে কমে যায় চীনের রপ্তানি। চীনের হারানো ক্রয়াদেশের একটি অংশ ওই বছর থেকে বাংলাদেশে আসতে থাকে। ওই বছর ৫৯৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। তারপর ২০২০ সালের শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। পরে করোনার কারণে রপ্তানিতে ধস নামে। গত বছর আবার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। বছর শেষে রপ্তানি হয় ৭১৫ কোটি ডলারের পোশাক। তার মানে তিন বছরের ব্যবধানে বাজারটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ১৭৫ কোটি ডলারের।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ বলেন, ভিয়েতনামের উদ্যোক্তাদের বড় অংশই চীন। ব্যবসাকে টেকসই করতে তারা ভিয়েতনামে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছেন। বাণিজ্যযুদ্ধ ও করোনার কারণে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা চীন থেকে ব্যবসা সরাতে শুরু করলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ক্রয়াদেশের বড় অংশই পেতে থাকল ভিয়েতনাম। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বাড়তি যে ক্রয়াদেশ আসছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের অংশই বেশি। ওভেনের চেয়ে নিট পোশাকের রপ্তানি বেশি বাড়ছে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের হারানো তৈরি পোশাকের ব্যবসা বাংলাদেশের আরেক প্রতিযোগী ভারতও পেয়েছে। দেশটি ২০১৮ সালে ৩৮১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল। গত বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ৪২০ কোটি ডলার। তিন বছরের ব্যবধানে তাদের রপ্তানি বেড়েছে ৩৯ কোটি ডলার। অবশ্য মোট রপ্তানিতে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও কম্বোডিয়া ব্যবসা বেশি পেয়েছে। ২০১৮ সালে তাদের রপ্তানি ছিল ২৪১ কোটি ডলার। গত বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ৩৩৯ কোটি ডলার। তার মানে ৩ বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রে কম্বোডিয়ার রপ্তানি বেড়েছে ৯৮ কোটি ডলার।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ভিয়েতনামের মতো কম্বোডিয়ার পোশাক কারখানাগুলো মূলত চীনারা করেছে। ফলে চীনের হারানো অনেক ক্রয়াদেশ কম্বোডিয়ায় গেছে। তারপরও বাংলাদেশ আরও বেশি ব্যবসা পেতে পারত। মূল সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পৌঁছাতে ৪০-৪৫ দিন সময় লাগে। ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া থেকে তার অর্ধেক সময়ও লাগে না। আবার শুল্ককরের ব্যাপারও আছে। তিনি বলেন, লিড টাইম (পণ্য উৎপাদন থেকে জাহাজীকরণ পর্যন্ত সময়) কমানো গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কয়েকশ কোটি ডলারের রপ্তানি বাড়ানো কোনো বিষয় না। সেই সঙ্গে শুল্ক ও করে ছাড় পেতে সরকারি পর্যায়ে দর–কষাকষি শুরু করার কথা বলেন তিনি।