নারীকে সর্বদা ছোট করা হয়, মা ধর্ম মেনে সারা জীবন তা বুঝিয়ে গেছেন আমাকে

২৭ তারিখ রাতে গ্রামের বাড়ীতে ছিলাম। আমাদের পাকা দেয়ালের ঘরটার উপরটা টিনের চালা, সিলিং আছে। রাতে ঠান্ডা কাকে বলে! বেশ ক’টা স্যুয়েটার, জেকেট পড়ে শুয়েছি। বার বার দুই নাক বন্ধ হয়ে যায়। মা সারারাত অবচেতনে চিৎকার করছিলেন। ভাই বোন কেউ ঘুমাইনি। আমি শীতে কাবু, নাক বন্ধটা সারতে সারারাত গেল। মানুষ কিভাবে এমন শীত মোকাবেলা করে!

মা একটা কথা ৫৫ বছর আগে বলছিলেন, তার চারপুত্রকে মাওলানা বানাবেন, তিনি মারা গেলে তার খাটিয়া চারপুত্র বহন করে কবরের কাছে নিয়ে যাবে। মাদ্রাসায় গেছিলাম, হুজুরের পিটনি সহ্য না করে বেতটা তাকে ছুড়ে মেরে চলে আসি। ছোটভাইও চলে আসে। একজনও মাওলানা হয়নি। আমি সেটা মনে রেখে ছোট ভাইকে বল্লাম, তুই, আমি, সোহেল, জুলিয়াস মায়ের খাটিয়া কাঁধে নিব। নিলাম, ওরে বাবা, স্টিলের খাটিয়া এত ভারী! দ্রুত ভাগিনারা এসে আমাদেরকে রক্ষা করলো।

পুরুষ মারা গেলে মাইকিং হয়, নারী মারা গেলে মাইকিং নাকি করা যাবে না। খাটিয়া কাঁধে নিতেও কে পারবে, কে পারবে না সে এক নানা নীতি হুজুররা তৈরী করেছে। নারীকে সর্বদা ছোট করা হয়। মা ধর্ম মেনে সারা জীবন তা বুঝিয়ে গেছেন আমাকে। মৃত ব্যক্তিকে কে কাঁধে নিতে পারবে বা পারবে না, সেখানেও নারীকে ভিন্ন করে দেখার মানে কি? কে কবরে নামাবে তাও নিয়ম। সবাই পারবে না। গোসলের আগে আমি মায়ের ছবিও সবার সামনে তুল্লাম। সব অপ রীতি যেন পরিবর্তন হয় যুক্তির নীরিখে।

পরদিন দুপুরে মা নীরব হয়ে গেলেন। কবরস্ত করতে রাত দশটা। এ রাতটা বোনদের সাথে ঘরে কাটাবো। আমার স্ত্রী আছে, মেঝ মেয়ে আছে। চাঁদপুর থেকে ছোট ভাই এসেছে। সবচাইতে ছোট ভাই সৌদি আরবে। মায়ের নাতি নাতনী দুই ডজন এসেছে ঢাকা ও বিভিন্ন এলাকা থেকে। 

নাতনিরা কাঁদছে। বোনরাও কেঁদে চলছে। কন্যারা মায়ের জন্য কাঁদে বেশি, নাতনীরাও। ইঞ্জিনিয়ার প্রিন্স বললো, তার মাও তার নানীর জন্য প্রায় এক বছর কেঁদেছিল। আরো ভাগনি, অন্য আত্মীয়রা কাঁদছে। ছোট বোন মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছে। সাথে পারভিনও। মেয়েটির একটা ছেলে হলে জামাই ছেড়ে দেয়। হতদরিদ্র ঘরের মেয়ে। গত ৫/৬ বছর মায়ের জন্য সব করেছে। আমরা বেশি বেতনেও কাউকে রাখলে ২/৩ দিনও টিকতো না। কখনো মা বিছানায় প্রাকৃতিক কর্ম সারতেন। এসব পরিস্কার করা কঠিন। পারভিন করতো। আমরা তিন ভাইয়ের থেকে মাসে টাকা দিতাম। ছোট বোন ঔষধ কেনা, ফলফলারী কেনা, খাবার সব ব্যবস্থা করতো। আমার ডাক্তার মেয়ে নিয়মিত পারভিনকে ফোন করতো। পারভিনও কন সমস্যা হলে তাকে আগে বলতো। একবার বললো, দাদুকে তার ছেলেমেয়ে নাতি নতনীরা মরতেই দিবে না। পারভিনকে বেতন দিত বড় ভাবী। বড় ভাই গত হয়েছেন। তার পরিবার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতো। পারভিন মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছে তার কি উপায় হবে। আমি জনসমক্ষে বলেছি, পারভিনের সারাজীবনের খরচ আমি পাঠাবো। আমাদের ৫ কক্ষের ঘরটাতেও কেউ থাকার নেই, সে থাক। তার ছেলেকে পড়াবো। আমার থেকে তাকে তিনশতক জমি রেজিষ্ট্রি করে দিব।

রাতে বোনদের সাথে থাকা দরকার। মনে হলো আজও যেরকম শীত, এ ঘরে থাকলে আমার অবস্থা ভয়াবহ হবে। ভাবীদের দালানে থাকতে বললো। নাহ, চাঁদপুর ছোট ভাইয়ের বাসায় এসে থাকবো। চলে আসলাম।

আসার আগে বিতর্ক, তিন দিনের মাথায় দোয়া করানো। গরিব খাওয়াতে হবে গরুর মাংস দিয়ে শত শত। কেন? এটা কি মহাভারতের জজ্ঞের অনুষ্ঠান? মানুষ মরলে যদি খাওয়ায় তবে গরিবরা চাইবো প্রতিদিন মানুষ মরুক। তাহের সরদার নেতা। বললো, সবাই করে। জেঠিমার উপর দোয়া বর্ষিত হয়। কোরানে আছে। বললাম, কোরানে নেই। আমার চেয়ে ধর্ম স্টাডি কে বেশি করেছে। বোনরা বললো খাওয়াতে হবে। না, খাওয়াবো না। দোয়া হবে। এ কালচার পরিবর্তন করবো।

পরদিন চাঁদপুর থেকে ঢাকা চলে আসলাম। ভাগিনা ভাগনি টাকা দিয়ে লোক খাওয়ালো। আমি কেবল দোয়ার জন্য টাকা দিলাম।

তারপর দুই রাত, শীত একটুও কমেনি। ঢাকাতেও প্রচন্ড অনুভব করছি। আর ভাবছি মা মাটির নীচে কিভাবে আছে? উত্তর দিকে মাথা রেখে পশ্চিমে মুখ রেখে শেয়ানো। এভাবেই শেষ হবেন। মিশে যাবেন মাটির সাথে। প্রকৃতিতে জন্ম, প্রকৃতিতে মিশে যাওয়া। আমাদের কল্পনায় থাকে শত বছরের এক মহাজীবন মায়ের আত্মা নামক মা বিশ্বময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কল্পনা একটা বড় শান্তনা। কল্পনাই প্রানরস। আমার বোনরা কেঁদেই চলছে। এমন জীবনের সংস্পর্শ ভুলে যাওয়া কঠিন।

লেখকঃ সর্দার আমীন

President at President Bangladesh Development & Environment Forum (BDEF), General Secretary, Bangladesh Student Union at Chittagong University of Engineering & Technology and works at Chief Engineer (former) at DBL-Group

শেয়ার করুনঃ