নারীর প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্য দূর করার জন্য উত্তরাধীকারে নারীর সমান অধীকারের দাবী

নারীর প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্য দূর করার জন্য উত্তরাধীকারে নারীর সমান অধীকারের দাবী

আজ ২৫ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে অক্সফাম বাংলাদেশ-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস)-এর উদ্যোগে ‘বৈষম্য দূর করার জন্য উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার চাই’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ-এর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর। প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন- সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড.সায়মা হক বিদিশা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহিন আনাম, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক এডভোকেট নিনা গোস্বামী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফৌজিয়া মোসলেম, দৈনিক সমকালের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান শেখ রোকন।  বৈঠকে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন অক্সফাম বাংলাদেশ-এর অর্ন্তবর্তীকালীন  কান্ট্রি ডিরেক্টর এনামুল মজিদ খান সিদ্দিকী । এছাড়া অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন নেটস-এর আফসানা বিনতে আমীন, ড. মাখদুমা নার্গিস রত্না, প্রাগ্রস্বরের নির্বাহী পরিচালক ফৌজিয়া খন্দকার ইভা, ড. হান্নানা বেগম, মানব প্রগতি সংঘ-এর নির্বাহী পরিচলক  মাহমুদা শেলী, সিড বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক সারথী রাণী সাহা প্রমুখ । অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বিএনপিএস-এর উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী। গোলটেবিল বৈঠকের মিডিয়া সহযোগী হিসেবে ছিল দৈনিক সমকাল।

অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে রোকেয়া কবীর বলেন-‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমানাধিকার দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হবার পরও এ দেশের নারীসমাজকে এখনো ব্যাপক বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। নারীর প্রতি বিদ্যমান সর্বব্যাপী বৈষম্যের মূলস্তম্ভ উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না থাকা, যা বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনসহ সমাজ-রাষ্ট্রে চলমান বিভিন্ন উপসর্গের মূল কারণ। এই মূল কারণে হাত না দেওয়ায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ সত্তে¡ও কিছুতেই এসব উপসর্গের রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, এগুলো রোগের উপসর্গ, মূল কারণে হাত না দিলে এই সংকট সমূলে উৎপাটন করা যাবে না। সেই মূল কারণটি হলো নারীর পায়ের নিচে মাটি না থাকা। এই সংকট মোকাবেলার সবচেয়ে কার্যকর মূল পদক্ষেপ হবে নারীর অর্থনৈতিক অবস্থা সৃদৃঢ় করা, তথা উত্তরাধিকারসহ সকল সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যা পরিবার, সমাজ ও রাজনীতিতে নারীর অবস্থান সুদৃঢ় করবে।

সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন- সংবিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন যেখানে জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার এর বিষয়টি স্বৃীকৃতি পেয়েছে। সংবিধানে বলা হয়েছে যদি কোন আইন সংবিধান পরিপন্থী হয় তবে সেই আইন বলবৎ থাকবে না। তিনি উল্লেখ করেন, ধমীয় অনুসরণ অনুযায়ী পারিবারিক আইনটি প্রণীত হয়েছে এবং তা এখনো কার্যকরী আছে যা নারীর জন্য বৈষম্য ও নির্যাতনের উৎসে পরিণত হয়েছে।  সর্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহিন আনাম বলেন- নারীর সকল প্রকার মজুরী-বিহীন কাজের কোন মূল্যায়ন নেই। একজন কন্যা শিশু জেনে যায় যে পরিবারে তার অবস্থান কোথায় আর তার ভাইয়ের অবস্থান কোথায়। সুতরাং নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন সরাসরি পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার না থাকার বিষয়টি জড়িত।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড.সায়মা হক বিদিশা বলেন- নারীর আর্থিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি আরো অন্যান্য ক্ষমতায়নের বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে হবে।  তিনি মনে করেন শিক্ষা ও কর্মসংস্থান নারী আর্থিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূণ। নারী যখন আত্মকর্মসংস্থানে প্রবেশ করছে তখন একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবেই কাজ করছে। কিন্তু তার ব্যবসা-কে সম্প্রসারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে কারণ তার সম্পদ সীমিত। অতএব তার নিজের পায়ে দাড়ানোর জন্য, স¦নির্ভর হওয়ার জন্য সম্পত্তি প্রাপ্তিতে সমান-অধিকার আবশ্যক।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফৌজিয়া মোসলেম বলেন- সব আইন সংবিধানের আলোকে তৈরি ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শুধুমাত্র এই আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে না নারীদের পশ্চাদপদ করে রাখার জন্য।  অবিলম্বে অভিন ও সার্বজনীন  পারিবারিক আইন প্রণষন ও চালু করে নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন বন্ধ করার পথ সুগম করতে হবে।

 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক এডভোকেট নিনা গোস্বামী বলেন – উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না থাকা নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না থাকায় শিশু বয়স থেকেই পরিবারে মেয়েশিশুকে লালনপালন করা হয় মূলত একটা উপযুক্ত পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে অন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার জন্য। পরিবারের এই মানসিকতা যেমন বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি করে, তেমনি জীবনভর নারীদের পরজীবী হিসেবে গণ্য হবার পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়।

বৈঠকে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তবে অক্সফাম বাংলাদেশ-এর অর্ন্তবর্তীকালীন  কান্ট্রি ডিরেক্টর এনামুল মজিদ খান সিদ্দিকী বলেন-দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ডিজিটাইজড হচ্ছে কিন্তু সমতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন আজও কেন এত নারীরা ভূমিহীন। শুধুমাত্র আইন পরিবর্তন বা সংশোধন যথেষ্ট হবে কিনা তা নিয়ে ভাবার দরকার । আইন পরিবর্তনের সাথে সাথে আইনী সহায়তা কিভাবে দেওয়া হবে, সামাজিক আন্দোলনে পরুষের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা কেমন হবে, কিভাবে পরুষদের সম্পৃক্ততার বৃদ্ধি করা যায় এই সকল বিষয়ে আরো চিন্তা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

 

দৈনিক সমকালের সম্পাদকীয় ভিাগের প্রধান শেখ রোকন বলেন- উত্তরাধিকারে নারীর  সমান অধিকার এটি শুধু আজকের দাবি না বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যেই নিহিত। তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন যে পাকিস্তান আমলের ১৯৬১ সালের মুসিলিম পারিবারিক আইন স্বাধীন বাংলাদেশে আজও  বলবৎ রয়েছে।

অনুষ্ঠানে বক্তারা ও নারীসমাজ ‘ উত্তারাধিকারে ও পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠার আইন পাশ করার বিষয়টি  মুজিব শতবর্ষে ও স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপহার হিসেবে দাবি করেন।

শেয়ার করুনঃ