দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও অসমতা ঐক্যব্ধভাবে দূর করার দাবী

১০ দফা দাবীতে ১৫ জানিয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি সারাদেশে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও অসমতা ঐক্যব্ধভাবে দূর করার দাবীতে ২২ জানুয়ারি ২০২২, সকাল ১১ টায়, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) এর উদ্যোগে, এরশাদনগর, গাজীপুর আলোচনা সভা ও মানব বন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও অসমতা ঐক্যবদ্ধভাবে দূর করি

বিগত ৩০ বছরে বিশ^জুড়ে ধনী সম্প্রদায়ের সাথে অন্যদের ব্যবধান বেড়েছে প্রকটভাবে। নিদারুণ বৈষম্যের দরুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে নিম্নমুখী, মানবাধিকার পড়েছে হুমকির মুখে এবং স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাত হয়েছে দুর্র্দশাগ্রস্ত। কেবল স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় প্রতিবছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিচ্ছে। যদিও যুব সম্প্রদায়ের প্রায় ৭০ মিলিয়ন সদস্য নিয়মিত কাজ করছে, তবু তারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে এবং দিনে মাত্র ২ ডলার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে জীবনধারণের সুযোগ পাচ্ছে। নিম্ন মজুরি প্রাপ্তির দিক থেকে সর্বাগ্রে অবস্থান করছে নারী, যা তাদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ করে রাখছে। শ্রমজীবী শ্রেণি সমাজ আরোপিত অসম বিন্যাস, নীতি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের এ সব অসম আচরণের ফলে নিদারুণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অথচ অসমতার এই জটিল সমীকরণ সমাজের জন্য প্রত্যাশিত নয়, সরকারসমূহের যে সমীকরণ ভাঙার সক্ষমতাও রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিশ্বের ১৯৩টি দেশ অসমতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে সংকল্পবদ্ধ হয়।

বৈষম্য নিরসনে দেশগুলোর এই সংকল্প সত্ত্বেও ধনী দরিদ্রের বৈষম্য প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে, যা করোনা মহামারির এই সময়ে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনাকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, স্বাভাবিক চলাচল নিয়ন্ত্রণ, কোয়ারেন্টাইন ও লকডাউন ঘোষণা এবং সেই সাথে অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় ব্যাবসায়ের উপর অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবু বিশ্বর জুড়ে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী করোনা স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পতিত হয়, যেটি অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে অভাবনীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, করোনা মহামারি সমাজে প্রচলিত বৈষম্যের চর্চা আরও গভীরভাবে লালন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং একইসাথে সাধারণ মানুষের জীবনকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছে। এই দুর্দশার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে সাধারণ শ্রমজীবী ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে, বিশেষভাবে যারা কাজ হারিয়েছে বা কাজের সাথে জড়িত নেই, নারী, যুবসমাজ, ভিন্নভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠী, যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম এবং যারা দুর্গম জায়গায় বসবাস করছে। আর এই জনগোষ্ঠীই ফাইট ইনইকুয়ালিটি অ্যালায়েন্স মুভমেন্টের মূল ধারক।

করোনাকালীন এই বিপর্যয়ের সময় ফাইট ইনইকুয়ালিটি অ্যালায়েন্স সেসব মানুষের পাশে মানবতার হাত বাড়িয়ে দেয় যারা এই মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইনইকুয়ালিটি অ্যালায়েন্স অসমতার মূলকাঠামো পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, এই সংঘবদ্ধ এগিয়ে চলার মধ্য দিয়ে করোনাকালীন সংকট কাটিয়ে উঠে স্পষ্টতই একটি নতুন পরিবর্তিত কাঠামো তৈরি করা সম্ভব।

ফাইট ইনইকুয়ালিটি অ্যালায়েন্সের সদস্যসহ মানবাধিকার সংগঠন ও ব্যক্তিসমূহ প্রতিবছর জানুয়ারিতে একটি গণজমায়েত করে এবং বিশ্বব্যাপী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আহবান জানায়।

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধারা ১৫-২২ জানুয়ারি ২০২২ মেয়াদকালে একত্রিত হবেন, জনগণের শক্তির জায়গাগুলো বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবেন এবং সরব কণ্ঠে উচ্চারণ করবেন “people’s solutions are better than Davos” আশার কথা যে, বিশেষজ্ঞবৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এখন স্বীকার করে যে, বৈষম্য মোকাবেলা করা আবশ্যক। এসডিজি ১০-এর আওতায় নিজের দেশ এবং অন্য দেশের মধ্যকার অসমতা দূর করার জন্য প্রত্যেক সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তা সত্ত্বেও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকারসমূহকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় কম। আমরা মনে করি, আমরা যখন তৃণমূল থেকে একত্রিত হব, শক্তি, চাহিদা, জবাবদিহিতা এবং বৃহত্তর সমতা গড়ে তোলার জন্য সংগঠিত হব, তখনই পরিবর্তন আসবে। জনগণের যৌথ শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোকে দায়বদ্ধ করবে।

 

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের দেশের, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের এবং অন্যান্য বিশ্বের সরকারসমূহকে আহবান জানাচ্ছি :

১. করোনার টিকা সবার জন্য উন্মুক্ত ও সহজলভ্য করুন;

২. করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা বাড়ানোসহ কাজের সুযোগ তৈরি করুন;

৩. ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন;

৪. এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করুন, যা নারীদের জন্য বৈষম্য ও শোষণমূলক নয়। আমরা চাই সরকারসমূহ অর্থনৈতিক বিনিয়োগে যত্নবান হবে, নারীদের মজুরিবিহীন কাজকে কমিয়ে আনবে ও পুনর্বণ্টন করবে;

৫. দেশীয় কর রাজস্ব সচল করা এবং ধনী ব্যক্তি ও কোম্পানির প্রতি অন্যায্য কর ছাড় বন্ধ করুন। ধনী ব্যক্তি ও কোম্পানির ন্যায্য ভাগ পরিশোধে বাধ্য করুন;

৬. জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিনিয়োগ করুন। দায়িত্বশীল রাষ্ট্র গড়ে তুলুন এবং সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করুন;

৭. শ্রমিক অধিকারগুলো আমাদের অর্থনৈতিক মডেলের ভিত্তিরূপে স্থাপন করুন। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, ন্যূনতম মজুরি আইন বাস্তবায়ন এবং লিঙ্গবৈষম্যমূলক বেতন পরিহারের মাধ্যমে করপোরেট লোভ পরিহার করুন;

৮. ক্ষতিগ্রস্ত/আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে জলবায়ূ বিপর্যয় রোধ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অযৌক্তিক প্রভাব দূর করুন;

৯. নারী ও ক্ষুদ্র কৃষকের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করুন এবং কৃষিভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাধান্য খর্ব করুন। খাদ্যের ভ্যালু চেইনের শোষণ থেকে নারী ও ক্ষুদ্র কৃষককে রক্ষা করুন;

১০. বৈষম্যের পরিবেশের মধ্যেই গণতান্ত্রিক অধিকার ও সুশীল সমাজের মুক্তচিন্তার স্থান নিশ্চিত করুন;

সাউথ এশিয়া অ্যালায়েন্স ফর পভার্টি ইরাডিকেশন (স্যাপি) বাংলাদেশ, ফাইট ইনইকুয়ালিটি অ্যালায়েন্স,বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস), ইনসিডিন বাংলাদেশ, জনউদ্যোগ ১০ দফা দাবীতে ১৫ জানিয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি সারাদেশে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছে।

শেয়ার করুনঃ