আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা ও টিভির পাশাপাশি বিভিন্ন জনসভা, গোলটেবিল বৈঠক ও সংবাদ সম্মেলনগুলোতে ‘দেশে গণতন্ত্র নেই’, ‘মানবাধিকার নেই’ ইত্যাদি নিয়ে উচ্চকিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। বিরোধী দলের নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী, এমনকি শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও এমনটি বলেন। নির্বাচন সামনে এলেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে কথা শুরু হয় এবং সেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শুধু প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য, সব জনগোষ্ঠীর জন্য নয়। আরেকটি বিষয়ে তারা বলেন, সেটি হলো শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। তাহলেই যেন দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে।
অর্থাৎ নির্বাচন একটি খেলার মাঠ, যেখানে শক্তিশালী রেফারি থাকবেন যিনি নিরপেক্ষভাবে খেলা পরিচালনা করবেন এবং যে গোল করবে নিরপেক্ষ রেফারি তার পক্ষে রায় দেবেন তাহলেই যেন গণতন্ত্র। এই বিবেচনায় ট্রাম্প এবং মোদি তো তাদের মতে গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা। এই অবস্থাদৃষ্টে আমার ক্ষুদ্র মগজে একটি প্রশ্ন জাগ্রত হয়েছে। যেজন্য গত ৬-৭ বছর ধরেই আমি বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেছি সব নাগরিকের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত করার ব্যাপারে, শুধু সরকারি দল ও বিরোধী দলের জন্য নয়।
সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র হয় না। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ও লিঙ্গ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার এবং নির্বাচিত হওয়ার জন্য সব উপাদানের সমান মালিকানা বা অভিগম্যতা প্রয়োজন। তা ছাড়া কোন প্রার্থী গণতন্ত্রমনা এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কাজ করবেন, ভোটারদেরও সে সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। আমরা জানি নির্বাচিত হওয়ার জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন টাকা বা সম্পদ, অন্যদিকে প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন পাওয়ার করিডর বা পাওয়ার হাউজের সমর্থন বা আনুকূল্য। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কমিটি, পেশাগত কমিটি, স্কুল-কলেজ কমিটি, মসজিদ কমিটি, বাজার কমিটি, ক্লাব ইত্যাদিতে উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ নির্বাচনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এসব ক্ষেত্রের প্রায় কোনোটিতেই নারীর উপস্থিতি নেই বা থাকলেও নামমাত্র।
আমরা দেখছি পরিবার, রাস্তাঘাট, যানবাহন, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিনোদন কেন্দ্র সব জায়গাতেই নারীরা যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার হয়। পরিবারে নারী নির্যাতনের হার কভিডকালে আগের চেয়ে আরও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ ছাড়া, বাল্যবিয়ে, জোরপূর্বক বিয়ে ইত্যাদিও সমানতালে চলছে। এগুলো নিয়েও শুধু সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুনতে পাওয়া যায়। সব পরীক্ষায় পাস করেও সম্প্রতি দুই চাকরিপ্রার্থী নারীর চাকরি আটকে গিয়েছিল স্থায়ী ঠিকানা না থাকার কারণে, শেষপর্যন্ত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাদের চাকরি হয়।
আমরা বোঝার চেষ্টা করি না যে, উল্লিখিত এই সমস্যাগুলো উপসর্গমাত্র এবং এর মূল কারণ সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর সমান অভিগম্যতা না থাকা। এর কারণে তারা পরিবার ও সমাজের কাছে পরগাছা হিসেবে গণ্য হয়, যার সূত্রপাত উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার না থাকা। উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না থাকায় নারীর পায়ের নিচে মাটি থাকে না। তাকে পরজীবী হিসেবে ভাসমান অবস্থায় থাকতে হয়। তার কোনো নিজস্ব ঠিকানা থাকে না। পরিবারে তাকে বড় করা হয় যেকোনোভাবে একটি ভালো বিয়ে দিয়ে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে পার করে দেওয়ার জন্য।
এ অবস্থার কারণে পরিবারে নারী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির সদস্যের মর্যাদা পায়, পুরুষদের হুকুম তামিল করা বা সেবাদানের কাজে নিয়োজিত থাকাই হয় তাদের মূল কাজ। এ রকম পরিবারগুলোতে যে সদস্যরা বড় হন, তারা গণতান্ত্রিক আচরণ, মনমানসিকতা নিয়ে বড় হন না বা এসবে অভ্যস্ত হন না। ফলে তারা যে ক্ষেত্রেই যাক না কেন, তা হোক রাজনীতি, অফিস-আদালত বা ব্যবসা-বাণিজ্য, রাস্তাঘাট সব ক্ষেত্রে তারা অগণতান্ত্রিক আচরণই করে থাকেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রধান পদক্ষেপ হবে উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
১৯৭১-এর এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মূলনীতি ছিল সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও এই নীতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে। নাগরিকদের সব অংশের সমান অধিকারের রক্ষাকবচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ধারা ২৮(১) অনুযায়ী রাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে : ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। এর অর্থ দাঁড়ায়, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রাষ্ট্রীয় ও আইনগতভাবে অবৈধ। অথচ দুঃখজনকভাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক কর্তৃক প্রণীত বৈষম্যমূলক ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনের বলে উত্তরাধিকারসহ সম্পদ ও সম্পত্তিতে সমান অধিকার পাওয়া থেকে বাংলাদেশের নারী সমাজকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যা সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রের ৫০ ভাগ জনগোষ্ঠী নারীর মানবাধিকার এবং নাগরিক হিসেবে তাদের সমান অধিকারের লঙ্ঘন। অথচ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য আইন বাতিল হয়ে যাবে বলে সংবিধানের ২৬(১) ও ২৬(২) ধারায় সুস্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে।
দেশের সব নাগরিকের অধিকার রক্ষা এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে বাংলাদেশের সব আইনই প্রণীত হয়েছে সংবিধানের আলোকে ইউরোপীয় সিভিল আইনের আদলে। শুধু নারী অধিকার খর্বকারী ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইনটিই হচ্ছে ধর্মীয় আইননির্ভর।
আমরা মনে করি, একটি স্বাধীন দেশে এমন দ্বৈতব্যবস্থা সুস্পষ্টভাবেই সংবিধান লঙ্ঘন। তা ছাড়া, এর মাধ্যমে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে’, ‘প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন’ [৭(২)] হিসেবে সংবিধানের প্রাধান্য খর্ব হয় এবং সংবিধান লঙ্ঘিত হয়। কাজেই এ আইন সংবিধানবিরোধী। দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক দল বা মানবাধিকারকর্মীদের কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখি না। ৫০ ভাগ জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার কায়েম না হলে দেশে গণতন্ত্র কার্যকর হবে না।
আমি সব রাজনৈতিক দল, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের বলছি, যদি সত্যিকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তবে ৫০ ভাগ জনগোষ্ঠী নারীর জন্য সাংবিধানিক ও আইনগত সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জোরদার করুন। উত্তরাধিকারে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন করার জোর দাবি তুলুন। তবেই বুঝব আপনারা সত্যিকার অর্থেই দেশে গণতন্ত্র চান।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে নারী সমাজের পক্ষ থেকে আমাদের আবেদন, মুজিববর্ষে দেশের জনগোষ্ঠীর ৫০ ভাগ নারী সমাজের জন্য উত্তরাধিকারে সমান অধিকারের আইন করে সংবিধান সমুন্নত করবেন। নারী সমাজ আপনার সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্ব থেকেই এই পদক্ষেপ আশা করে।
রোকেয়া কবীর, লেখক মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী নির্বাহী পরিচালক, নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস)
(২২ জানুয়ারি ২২ দেশ রূপান্তর প্রকাশিত https://www.deshrupantor.com/editorial-news/2022/01/22/340607)