“মাইনকার চিপায়’ দেশ”-মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

আমাদের দেশে ‘মাইনকার চিপা’ বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। কোথা থেকে কথাটির উৎপত্তি আমার জানা নেই। তবে কথাটির অর্থ অনেকেরই জানা। ‘মাইনকার চিপা’ বলতে এমন এক অসহনীয় অবস্থার কথা বোঝায়, যখন কারও ওপর বিপরীতমুখী ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘অবস্থার-চাপ’ এমনই বোঝা হয়ে ওঠে যে, তার পক্ষে কোনোদিকে এদিক-সেদিক করেও শান্তি পাওয়ার পথ থাকে না। এটি একটি মারাত্মক ও অনতিক্রমযোগ্য উভয় সংকটের দুঃসহ পরিস্থিতি। ক্ষমতাসীন সরকারও সেই সঙ্গে দেশের ক্ষেত্রে এখন অনেকটা তেমনই ‘মাইনকার চিপায়’ পড়ার হাল দাঁড়িয়েছে। কেন ও কীভাবে আজ দশা এমন হয়ে উঠল?

পাকিস্তানি আমলে সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় ‘২২ পরিবার’ বাঙালি জাতির ওপর পুঁজিবাদের নামে ‘লুটপাটতন্ত্রের’ ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছিল। লুটপাটতন্ত্রের এ ধরনের ‘ব্যবস্থার’ সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক উপরিকাঠামো ছিল ‘স্বৈরাচারী একনায়কত্ব’। এই শোষণ ব্যবস্থার সঙ্গে ‘গণতন্ত্র’ শুধু বেমানানই ছিল না, তা ছিল অবাধ লুটপাটের পথে বাধা সৃষ্টিকারী একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। সে কারণেই পাকিস্তানের বুকে কখনই ‘গণতন্ত্রকে’ প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয়নি।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি আমলের শোষণব্যবস্থা তথা লুটেরা পুঁজিবাদ পরিত্যাগ করে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক উপরিকাঠামো হলো ‘গণতন্ত্র’। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দেশি-বিদেশি শত্রুরা ‘সমাজতন্ত্রের’ এই লক্ষ্যের বিরোধী ছিল। তারা চেয়েছিল, ‘পাকিস্তানি জমানার’ লুটপাটতন্ত্রের ব্যবস্থাটিই বহাল থাকুক। তবে শুধু পাঞ্জাবি শোষকদের জায়গাটি বাঙালি শোষকদের দ্বারা হস্তগত হোক। সে উদ্দেশ্যে তারা মরিয়া ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। সেই ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য জনগণের শক্তিকে সংগঠিত করা ও গণতন্ত্রকে আরও প্রসারিত ও গভীরতর করা উচিত ছিল। তৎকালীন সরকার ও ক্ষমতাসীন দল অনেক রকম গণবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ পথ ত্যাগ করে ‘বাকশাল’ নামে একটি একক জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছিল। এমন অবস্থাতেই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। ‘সমাজতন্ত্রের’ লক্ষ্য পরিত্যাগ করে দেশে আবার নিরঙ্কুশ ‘লুটপাটতন্ত্রের’ নয়া-উদারবাদী পুঁজিবাদের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

১৯৭৫-এর পর দেড় দশক ধরে জিয়া ও এরশাদের শাসনকালে দেশ পরিচালিত হয়েছিল ‘লুটপাটতন্ত্রের’ এই অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থায়। এই শোষণের ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার কারণেই সে সময় ‘গণতন্ত্রের পরিবর্তে’ সামরিক শাসন, বেসামরিক লেবাসে সামরিক কর্তৃত্ব, রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা, ইত্যাদি উপাদানকে ভিত্তি করে রচনা করা হয়েছিল ‘স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্বের’ রাজনৈতিক উপরিকাঠামো। কিন্তু এই কাঠামোকে ভিত্তি করে রচিত শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য জনগণের জীবনপণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে নব্বইয়ে এরশাদের একনায়কত্ববাদী স্বৈরশাসনের পতন ঘটেছিল।

এরশাদ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ’৯০-এর বিজয়ী সংগ্রামের ফলে দেশে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র, বেসামরিক রাজনৈতিক সরকারের অধীনে রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি ব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ সূচিত হয়েছিল। এই নতুন পরিস্থিতিতে ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক উপরিকাঠামোর মধ্যেই শাসক-শোষক গোষ্ঠীকে নিজেদের শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার নতুন পথ ও পন্থা নির্মাণ করে নিতে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে দুর্ভাবনার বিষয়টি ছিল, ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের নতুন ব্যবস্থায় সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতিও পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা (তাদের ক্ষেত্রে যা কিনা আশঙ্কা) থেকে যায়। কোনো নতুন সরকার এসে যদি ‘লুটপাটতন্ত্রের’ ব্যবস্থা থেকে দেশকে সরিয়ে নিয়ে সমাজতন্ত্র অভিমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তা হলে তাদের ‘লুটপাটের’ সহজ সুযোগটি ক্ষুণ্ন হয়ে যেতে পারে। ‘গণতন্ত্রের’ লেবাস বজায় রেখেই সেই আশঙ্কা রোধ করতে পারাটিই ছিল তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ।

এমতাবস্থায়, এ ধরনের কোনো সমস্যা যেন সৃষ্টি না হতে পারে সে রকম একটি নিশ্চিত পথ বের করতে তারা তখন থেকেই চেষ্টা শুরু করেছিল। সেই পথ তারা পেয়ে গিয়েছিল ‘দ্বিদলীয় মেরুকরণভিত্তিক ব্যবস্থার’ ফর্মুলাতে। এই ফর্মুলা প্রয়োগ করে তারা কেবল দুটি দল তথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে অর্থপূর্ণ পরিমাণে বড় হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। অন্য সব দল যাতে এই দুটি দলকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক মেরুকরণের বাইরে অর্থপূর্ণ শক্তিসম্পন্ন হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে প্রাসঙ্গিক না হয়ে উঠতে পারে, তার ব্যবস্থাও একই সঙ্গে তারা করেছিল। একই সঙ্গে এই দুটি দলকে দেশি-বিদেশি শোষকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যাতে করে এদের মধ্যে ক্ষমতার হাতবদল হলেও ‘লুটপাটের’ নীতি ও ব্যবস্থার যেন কোনো পরিবর্তন না ঘটে। সরকারকে যেমন তারা রেখেছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে, একইরকম নিয়ন্ত্রণে বেঁধে ফেলেছিল প্রধান বিরোধী দলকে। পাঁচ বছর পরপর এই দুই দলের মধ্যে ‘মিউজিক্যাল চেয়ারের’ মতো ক্ষমতার হাতবদলের ব্যবস্থাও তারা ‘নির্মাণ’ করেছিল।

রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এবং জনগণের সামাজিক মনস্তত্ত্বে তারা এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল, যাতে করে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে উল্লিখিত এই দুটি দলই মানুষের চিন্তাজগৎ একচ্ছত্রভাবে দখল করে নিয়েছিল। অবস্থা এমন করে তোলা হয়েছিল যে, রাজনীতি, সরকার, রাষ্ট্রক্ষমতা- এসব বিষয় যেন কিনা কেবলই হয় নৌকা, না হয় ধানের শীষের বিষয়। কেবলই হয় আওয়ামী লীগ, না হয় বিএনপির বিষয়। অর্থাৎ যে আওয়ামীভুক্ত নয়, ধরে নিতে হবে যে তিনি নিশ্চয়ই বিএনপির লোক, আর যে বিএনপিভুক্ত নয় তিনি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের লোক। কোনো স্বাধীন বিকল্প শক্তির উত্থান রোধ করার জন্যই তারা এই পরিস্থিতি দাঁড় করিয়েছিল।

তবে শুধু একবার তারা ‘তৃতীয় শক্তিকে’ ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করেছিল। ওয়ান-ইলেভেনের পর ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলার সঙ্গে সঙ্গে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের মাধ্যমে একটি ফরমায়েশি তৃতীয় শক্তি গঠনের লক্ষ্যে তারা তৎপর হয়েছিল। ‘বিকল্পের’ আওয়াজ নিয়ে তারা কিছুদিন মাঠ গরম করেছিল। কিন্তু সেই বিকল্প ছিল ভুয়া বিকল্পের একটি ছলনামাত্র। সরকার ও বিরোধী দল- দুটোকে হাতে রাখতে পারা সত্ত্বেও এই দুই পক্ষের মধ্যে কামড়া-কামড়ি ও আত্মঘাতী সংঘাত-সংঘর্ষের জন্য শান্তিমতো শোষণ করা যাচ্ছিল না দেখে তারা একটি ‘আজ্ঞাবহ বিকল্প শক্তিকে’ গদিতে বসানোর প্ল্যান নিয়েছিল। সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের পাশাপাশি ‘বিকল্প শক্তিকেও’ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য তখন তারা চেষ্টা করেছিল।

নির্বাচনকে টাকার খেলা, প্রশাসনিক কারসাজি ইত্যাদির মাধ্যমে ‘নিয়ন্ত্রিত তামাশায়’ পরিণত করেও শাসকগোষ্ঠী দুটি দলের মধ্যে গদি বদলের ‘মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা’ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের অধ্যায় সমাপ্ত হওয়ার পর রাজনীতির ‘দ্বিদলীয় কাঠামোতে’ বড় রকম ধাক্কা এসেছিল। শোষকগোষ্ঠীকে সামনে নিয়ে আসতে হয়েছিল ‘সরকারের ধারাবাহিকতা’ বজায় রাখার যুক্তি দেখিয়ে ‘একদলীয় কাঠামোর’ ফর্মুলা। ‘ক্ষমতাসীন দল’ তাদের লুটপাটের সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয় সেজন্য চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত হলে কৃত অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে ভীত থেকেছে। তাই তারা গদি দখলে রাখার জন্য মরিয়া হয়েছে। এজন্য মানুষের ভোটাধিকার হরণ করারও ফন্দিফিকির চালিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির ফন্দি ব্যর্থ হলেও আওয়ামী লীগ সফল হয়েছে। এর পর নানা ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে তারা এখন একনাগাড়ে তৃতীয় দফা ক্ষমতা দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ‘দ্বিদলীয় মেরুকরণ’ভিত্তিক কাঠামোকে সে এখন ‘স্থায়ী একদলীয় আধিপত্য’ভিত্তিক কাঠামোতে পরিণত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘একতরফা নির্বাচনের’ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একাদিক্রমে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য গদিতে আসীন হতে পেরেছিল। যা ঘটানো হয়েছিল তা মোটেও কেবল একটি বা কয়েকটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয় ছিল না। সেবার ১৫৬টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হওয়ায় (সরকার গঠনের জন্য যা কিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন) বিনা ভোটে সরকার গঠনের ব্যবস্থাও সে করে নিতে পেরেছিল। ‘নিয়ম রক্ষার’ জন্য এ রকম করতে হয়েছিল বলে এই অবাঞ্ছিত ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেও রাজনীতিতে তার গভীর ক্ষত থেকে গিয়েছিল।

২০১৯ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে, আওয়ামী লীগের জনসমর্থন আরও কমে যাওয়ায় গদি ধরে রাখার জন্য তাকে ভিন্ন পন্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল। গোপন পরিকল্পনা ও নির্দেশনার মাধ্যমে পুলিশসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি কাজে লাগিয়ে ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ২৯ ডিসেম্বর রাতেই তাকে সম্পন্ন করতে হয়েছিল। এভাবে জনগণের ভোটাধিকারের ন্যূনতম সুযোগটিরও কবর দেওয়া হয়েছিল। কার্যকর করা হয়েছিল ‘নৈশকালীন ভুয়া ভোটের’ তামাশা। জনসমর্থন ও জনসম্মতির বদলে সরকার এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে মূলত ‘রাষ্ট্রযন্ত্র’ ও বিদেশি প্রভুদের প্রত্যক্ষ মদদে। তারাই এখন রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রকের আসনে। এ রকম অবস্থাই যে ফ্যাসিস্ট প্রবণতার জন্ম দেয়- ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়।

দুর্নীতি-লুটপাটের শক্তি এবং ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের’ সরাসরি মদদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। তার ক্ষমতায় টিকে থাকাটি এই লুটেরা ও স্বেচ্ছাচারী শক্তির কায়েমি স্বার্থ রক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। তাই তাকে ‘যেনতেন উপায়ে’ হলেও ক্ষমতায় রাখা হচ্ছে। ‘যেনতেন উপায়ে’ ক্ষমতা এবং ‘জনসমর্থনের ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে’ ক্ষমতা- এ দুটো হলো ভিন্নপথ ও পন্থা। দেশে নির্বাচিত সরকার ও বহুদলীয় ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। এই সাংবিধানিক পথ থেকে সরে গেলে আওয়ামী লীগ (ও সেই সঙ্গে সব রাজনৈতিক শক্তিই) রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। তাই তাকে ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমেই ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত জনসমর্থন না থাকায় প্রহসনের নির্বাচন ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচনে তার জয়লাভ করার সুযোগ নেই। তাই জনগণের ভোটাধিকার হরণ বা খর্ব করার ফন্দিফিকির ছাড়া তার পক্ষে ক্ষমতা দখল করে রাখা সম্ভব নয়। শাসক-শোষক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে ক্ষমতায় থাকার জন্য তাই সে গণতন্ত্রবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে এবং সে যত বেশি এসব কাজে লিপ্ত হচ্ছে, তত বেশি করে তার জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। এভাবে ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচারী প্রবণতা ও গণবিরোধী কাজের চোরাবালিতে সে আরও বেশি করে ডুবে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ আজ যে বড় ধরনের ‘মাইনকার চিপায়’ পড়েছে তার স্বরূপের একটি প্রধান দিক হলো এটি।

কয়েক দশকে দেশের রাজনীতি ডানপন্থার দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েছে। দেশি-বিদেশি শোষকরা অবস্থাকে এখানে ‘ফ্রিজ’ করে রাখতে চায়। একমাত্র প্রকৃত বামপন্থি শক্তির উত্থানের মধ্য দিয়েই এ ‘মাইনকার চিপা’ থেকে বেরিয়ে এসে দেশের দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার বর্তমান অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব। শাসক-শোষকরা তা ঠেকাতে চায়। তাই বামপন্থি ও সৎভাবে পরিচালিত স্বাধীন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির জন্য রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা প্রচণ্ড রকম সব বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে।

শুধু তাই নয়। জনগণের মৌলিক স্বার্থের কোনো ইস্যুতে বামপন্থি বা সৎ দেশপ্রেমিক দলের খবরাখবরগুলোকে মিডিয়াতে সেভাবে স্থান দেওয়া হয় না। মিডিয়ার বেশিরভাগের মালিকানা লুটেরা ধনিকদের হাতে। বামপন্থি ও বিকল্প শক্তির তৎপরতার খবরকে বস্তুত অচ্ছুত করে রাখা হয়েছে। তবে এ কথাও সত্য যে, বামপন্থি দল ও শক্তির মধ্যেও অনেক ভুল-ত্রুটি-দুর্বলতা-সংকীর্ণতা-অনৈক্য ইত্যাদি রয়েছে।

গোটা দেশ আজ যে ‘মাইনকার চিপায়’ নিক্ষিপ্ত, তার স্বরূপটি এখানেই বিরাজ করছে। দুটি বুর্জোয়া দলের চরম দেউলিয়াপনা সত্ত্বেও তারাই এখনো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবল আধিপত্য বজায় রেখে চলেছে। বাম গণতান্ত্রিক শক্তি প্রবল প্রতিকূলতার মুখে কাজ করে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তাদের শক্তি-সামর্থ্যকে তারা এখনো ‘ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি’ হিসেবে দৃশ্যমান করতে পারেনি। তারা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হলেও তাদের শক্তি-সামর্থ্য এখনো ততটা হয়ে ওঠেনি যে জনগণ তাদের ওপর ‘ভরসা’ করতে পারে। তাই ভরসা করা যায় না বলে ব্যাপক জনগণ এখনো তাদের পেছনে এসে দাঁড়াচ্ছে না। এদিকে আবার, জনগণ তাদের পেছনে সেই পরিমাণে সমবেত না হওয়ার কারণে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্পের সক্ষমতা ভরসা পাওয়ার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারছে না।

এই ‘মাইনকার চিপা’ থেকে দেশকে বের করে আনার কাজটি সম্পন্ন করতে হবে বামপন্থিদেরই। তাদেরই কঠিন মাটি কামড় দিয়ে নিরলস, ধৈর্যশীল, নীতিনিষ্ঠ, সাহসী, দৃঢ়চেতা, সাহসী প্রয়াসের মাধ্যমে রাজনীতির অঙ্গনের বিরাজমান একচ্ছত্র বুর্জোয়া আধিপত্য খর্ব করে নতুন শক্তি-বিন্যাস ও শক্তি-ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশের দুঃসহ ও বিপজ্জনক অচলায়তন ভাঙার এটিই পথ!

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *