পনেরই আগস্টের সেই কালরাত

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। কথা ছিল যে সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। ঘুরে ফিরে দেখবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই তাকে এক সময় বহিষ্কার করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের ন্যায়সংগত দাবিতে পরিচালিত ধর্মঘট সংগ্রামের প্রতি তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। সংহতিমূলক ছাত্র ধর্মঘট সংগঠিত করে সরাসরিভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এই ছিল তাঁর ‘অপরাধ’। এই ঘটনার প্রায় তিন দশক পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই সেই বহিষ্কৃত ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে’ সসম্মানে বরণ করে নিতে প্রস্তুত হয়েছিল।

বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিতে। উৎসবের আমেজে সুসজ্জিত ও মুখরিত হয়েছিল ক্যাম্পাসের সবগুলো ভবন, আঙ্গিনা, প্রাঙ্গণ। কথা ছিল যে, ক্যাম্পাসে পদার্পণের পর বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের শহীদদের মাজার জিয়ারত ও সেখানে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন। তারপর তিনি মোটর শোভাযাত্রা যোগে সমগ্র ক্যাম্পাস এলাকা ঘুরবেন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করবে। জগন্নাথ হল ও সেখানকার বধ্যভ‚মিতে তিনি কিছুক্ষণ থাকবেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি ফজলুল হক হলের ছাত্র ছিলেন বিধায় তিনি শহীদুল্লাহ হল হয়ে সেই হলে যাবেন। শিক্ষকদের সাথে ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে বেশ কিছু সময় কাটাবেন। তারপর টিএসসি মিলনায়তনের এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিবেন। আমি তখন যেহেতু ডাকসুর ভিপি, তাই স্বাভাবিক কারণে আমার ছিল এসব বিষয়ে একটি বড় দায়িত্ব।

হাজার হাজার ছাত্র ও সাধারণ মানুষ যারা তাঁর বক্তৃতা শুনতে চান, তারা সকলেই যেন তা শুনতে পারেন সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। কলা ভবন, মল চত্বর, নীলক্ষেত, শহীদ মিনার, চানখারপুল, দোয়েল চত্বর এলাকা জুড়ে মাইক লাগানো হয়েছিল। কথা ছিল যে সকাল থেকে এই মাইকে দেশাত্মবোধক গান, কবিতা আবৃত্তি, যন্ত্রসংগীত ইত্যাদি প্রচার করা হবে। একটি উদ্দীপনামূলক ও আনন্দঘন আবহে সমস্ত ক্যাম্পাসকে ভরিয়ে তোলা হবে। সমস্ত এলাকা সুন্দর সুন্দর ব্যানার, হোর্ডিং, ফেস্টুন ইত্যাদি দিয়ে সুশোভিত করা হয়েছিল। সকলেরই অধীর অপেক্ষা, কখন ১৫ আগস্টের সূর্যোদয় হবে, কখন বঙ্গবন্ধু ক্যাম্পাসে পদার্পন করে আলোকিত করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। কিন্তু না; তিনি এলেন না। তাকে আসতে দেয়া হলো না। প্রভাতের সূর্যোদয়ের আগেই নেমে এলো ঘাতকের মরণ আঘাত। মারণাস্ত্রের ব্রাশ ফায়ারের বুলেটে প্রত্যেকের বুক ঝাঁঝরা করে হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শিশু সন্তান রাসেলসহ ঢাকায় থাকা তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে।

বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনকে কেন্দ্র করে সর্বত্র ছিল ব্যাপক তোড়জোড়। কিন্তু পর্দার পেছনে চলছিল মরণ ছোবল মারার জন্য কুটিল-হিংস্র ষড়যন্ত্রের আয়োজন। ষড়যন্ত্রকারীরা দুর্বল ছিল না। তাদের সাথে ছিল আন্তর্জাতিক মদত। সরকারের নানা ব্যর্থতা, গুরুতর ভ্রান্তি ও ত্রুটি-বিচ্যুতির সুযোগে তারা সুকৌশলে তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছিল। বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে চরম উদাসিনতা, ‘কোনো বাঙালি আমার গায়ে হাত তুলবে না, হাত তুলতে গেলে তার হাত কেঁপে যাবে’ এ মর্মে তাঁর অন্ধ বিশ্বাস এবং শত্রু যে কতো ভয়ঙ্কর বর্বর হতে পারে সে সম্পর্কে উপলব্ধির দুর্বলতাকে তারা কাজে লাগিয়েছিল। ঘরের মধ্যেই ছিল শত্রুর চর। উপযুক্ত সময় বাছাই করে তারা দক্ষতার সাথে চরম আঘাত হেনেছিল।

আগস্টের মাত্র কয়েকমাস আগে বঙ্গবন্ধু দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সূচনা করেছিলেন। দেশে একক একটি ‘জাতীয় রাজনৈতিক দল’ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা রেখে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী সাধন করা হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই এই বিধান প্রয়োগ করে গঠন করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল)। বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণায় গড়ে ওঠা, ও সেই দাবিতে দীর্ঘ অনেক যুগ ধরে সংগ্রাম করে আসা, বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। এসব পদক্ষেপের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য সম্পর্কে মানুষকে বুঝিয়ে তোলা ও সচেতন করার কাজ ভালোমতো শুরুই করা হয়নি। নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর বাকশালের কমিটিগুলো তখনো গঠিত হয়নি। এরকম একটি শূন্যতার সুযোগ নিয়ে শত্রুরা তাদের আঘাত হানার দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করেছিল।

নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর সরকার বেশ পরিমাণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে উগ্র আওয়ামী বিদ্বেষী জাসদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছিল। বাকশাল গঠন হওয়ার কারণে নয়, আগে থেকেই জাসদ ছিল অন্ধভাবে আওয়ামী-শাসনের বিরুদ্ধে। সরকার উৎখাতের জন্য তারা রাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করার হঠকারী ও জঙ্গি কর্মসূচিও গ্রহণ করেছিল। গণবাহিনীসহ নানা গোপন তৎপরতায় তাদের অনেকেই লিপ্ত ছিল। ছাত্র সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে তাঁর প্রতি বৈরী মনোভাব বিরাজ করতে থাকা একটি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ক্যাম্পাসে আসার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে চলছিল একদিকে নানা দ্ব›দ্ব-বিরোধ এবং অন্যদিকে আদর্শগত বিভ্রান্তি। ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, জোট নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র অভিমুখীনতা ইত্যাদি নীতির বৈরী একটি শক্তি সব সময় আওয়ামী লীগের ভেতরে সক্রিয় ছিল। তাদের নেতা খুনী মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুব নিকটে স্থান করে নিয়েছিল। মোশতাককে দাউদকান্দি আসন থেকে জিতিয়ে আনার জন্য ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রেখে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে ‘চূড়ান্ত’ ফলাফলের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। তাকে বাকশালের প্রেসিডিয়ামে স্থান দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে মোশতাকের ষড়যন্ত্রমূলক চরিত্র সম্পর্কে জানতেন না, তা নয়। কিন্তু, শত্রু যে কতো ধূর্ত ও ভয়ঙ্কর হতে পারে তার হিসেব কষতে বঙ্গবন্ধুর ভ্রান্তি ঘটেছিল। সেটাই হয়ে উঠেছিল তার জন্য প্রাণঘাতী।

১৫ আগস্টের ঘাতক কালো শক্তি লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রস্তুতি নিয়েছিল অনেকটা নিখুঁতভাবেই। তারা প্রচারণা চালিয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিয়ে নিজেকে ‘আজীবন রাষ্ট্রপতি’ হিসাবে ঘোষণা করবেন এবং দেশে ‘রাজতন্ত্র’ প্রবর্তন করবেন। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে তারা নিবিড় সংযোগ স্থাপন করেছিল। রাষ্ট্রের কিছু স্পর্শকাতর স্থানে তারা অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে অন্তর্ঘাতের আয়োজন সম্পন্ন করেছিল।

১৫ আগস্টের ২/৪ দিন আগে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও তাদের কিছু প্রত্যক্ষ তৎপরতা শুরু হয়েছিল। ১৩ আগস্ট পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা সম্বলিত একটি লিফলেট ক্যাম্পাসের দু’চারটি জায়গায় বিতরণ করা হয়েছিল। ১৪ আগস্ট সকালে শামসুন্নাহার হলের গেইটের পাশে দেয়ালে পাকিস্তানের পতাকা সাটানো হয়েছিল। বেলা ১১/১২টার দিকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন একটি স্থান, সাইন্স এ্যানেক্স বিল্ডিং-এর দোতলায় গণিত বিভাগের বাথরুমসহ ২/৩টি স্থানে শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছিল। নিরাপত্তা সম্পর্কে আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়েছিলাম।

কয়েকজনকে নিয়ে আমি দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে গিয়েছিলাম। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আমরা দ্রুত খবর দিয়েছিলাম। তারা বিভিন্ন এলাকায় মেটাল ডিটেক্টর ও মাইন ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করেছিল। সন্ধ্যার পর সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান ক্যাম্পাসে আসলে তার সাথে টিএসসিতে আমার দেখা হয়। তিনি আশ্বাস দেন যে নিরাপত্তা সম্পর্কে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ধারণা করা যায় যে এসব ছিল একটি ‘ডাইভার্শনারী’ কৌশল। কারণ, পরদিন কাকডাকা ভোরে যখন ধানমন্ডির ৩২নং-এর বাসায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হচ্ছে, তখন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর লোকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার আয়োজন করতে ব্যস্ত। কি অদ্ভুত ও রহস্যজনক ব্যাপার!

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাজের পাশাপাশি আমরা ছাত্র সমাজের নিজ নিরাপত্তা তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমরা নিজেরাও বেশ কিছু সেচ্ছাসেবককে সাথে নিয়ে সারা রাত জেগে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা ক্যাম্পাস এলাকায় নজরদারী ও পাহারার উদ্দেশ্যে টহল দেয়ার কাজে নিয়োজিত ছিলাম। বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলে আমরা ক্যাম্পাসে রাতভর চক্কর মারছিলাম।

শেখ কামালও একজন সেচ্ছাসেবক ছিলেন। রাত দেড়টা দুটার দিকে শেখ কামাল সকাল সকাল এসে আবার কাজ শুরু করার প্রতি শত্রু দিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়েছিল। সদ্য তার বিয়ে হয়েছে এই কথা চিন্তা করে এবং বঙ্গবন্ধুর মোটরকেডের সাথে নয়, সকাল ৮টার মধ্যে আলাদাভাবে সে ক্যাম্পাসে আসবে এই শর্তে তাকে আমি যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলাম। আজও আমার একটি বড় যন্ত্রণা হয় এ কথা ভেবে যে, শেখ কামালের জীবন হয়তো রক্ষা পেত যদি আমি সেদিন আরেকটু ‘অমানবিক’ হয়ে তাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে আমাদের সাথে রেখে দিতাম!

যখন আমরা ভাবতে শুরু করেছি যে সারা রাতের কাজ হয়তো এখন শেষ হয়ে এলো, তখনই বহুদূরে কামান, মর্টার ও গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। মোটরসাইকেলে দুজনকে সেই আওয়াজের উৎস সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য পাঠালাম। তারা ফিরে এসে জানালো যে ধানমন্ডির দিকে গোলাগুলি হচ্ছে। আওয়াজের কাছাকাছি কেউ যেতে পারছে না। বিস্তারিত খবরের জন্য আরেকটি দলকে সেদিকে পাঠালাম। তারা ফিরে এসে রিপোর্ট করার আগেই রেডিওতে প্রচারিত ঘোষণা শুনে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়লেও হতবিহ্বল না হয়ে কলা ভবনের চত্বরে দাঁড়িয়েই তৎক্ষণাৎ কর্তব্য স্থির করে ফেলেছিলাম। কয়েকজন ছাত্র নেতাকে নিয়ে প্রথমে হাতিরপুলের একটি বাসায় উঠে টেলিফোনে কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে নির্দেশ পাওয়া মাত্র প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলাম। এদিকে চারদিকের খবরা-খবরও যথাসম্ভব নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। একের পর এক খবর আসছিল যে ঘাতক মেজররা ক্ষমতায় তাদের অবস্থানকে ক্রমেই সুসংহত করতে সক্ষম হচ্ছে। দুপুরের আগেই তিন বাহিনীর প্রধান এবং বিডিআর, পুলিশ প্রধানগণ কর্তৃক একে একে খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা আসতে থাকে। মাত্র ৪/৫ জন বাদে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সব সদস্যরা একের পর এক খুনি মোশতাকের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে থাকেন।

দুপুরের মধ্যেই পরিস্কার হয়ে যায় যে, ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পাশাপাশি এক প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে সফলকাম হয়েছে। সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান টহল দিতে থাকে। বেতারে খুনীদের পক্ষে একতরফা প্রচারণা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের সরকারই বহাল রয়েছে, মানুষের মনে এমন ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে সেই দলের নেতাকর্মীদের নিস্তেজ ও বিভ্রান্ত করে রাখা হয়। এমতাবস্থায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ মিছিল করার চিন্তা বাদ দিতে হয়। কিছুটা সময় নিয়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রতিরোধ শুরু করতে হবে। এ কথা আমরা অনুধাবন করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ শুরু হওয়া মাত্র ক্যাম্পাসে মিছিল করার মধ্যদিয়ে প্রকাশ্য প্রতিরোধ সূচনা করা হবে।

এসময় অল্প কয়েকজন বাদে ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রায় সবাই উধাও হয়ে যায়। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা সাহস নিয়ে কিছুটা পরিমাণে প্রকাশ্যে যাতায়াতরত থাকে। অক্টোবরের ২০ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়। আগেই পরিকল্পনা করে ক্যাম্পাস খোলার দিনই ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের নেতৃত্বে ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’ শ্লোগান সহকারে কলা ভবনের সবগুলো করিডরে ঝটিকা মিছিল হয়। ছাত্র-শিক্ষকরা হতবিহ্বল হয়ে ওঠে। পরদিন ক্লাসে ক্লাসে যেয়ে বক্তৃতা করে মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের আহ্বান জনানো হয়। ৪ নভেম্বর শোক মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। একটি লিফলেট ছাপিয়ে প্রচার করা হয়। লিফলেট বিতরণ করতে যেয়ে ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতা কর্মী গ্রেফতার হয়ে যায়। কিন্তু কোনো কিছুতে আমরা দমিত হইনি।

৪ নভেম্বর বহু পূর্বে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় হাজারে হাজারে সমবেত হই। আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে আমি আবেগময় বক্তৃতা দেই। এরপর ৩২নং-এর বাড়ি অভিমুখে মৌন মিছিল শুরু হয়। নীলক্ষেত ফাঁড়ির সামনে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে যাই। ৩২নং-এর বাড়ির সামনে গিয়ে বন্ধ গেইটের সামনে সকলের পক্ষ থেকে পুষ্পমাল্য অর্পণ করি। ঢাকার রাজপথে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রথম মিছিল। বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া বারুদের গন্ধ মুছে ফেলার কাজটি সূচীত হয় এভাবেই। সেই কাজ কিন্তু এখনো সম্পূর্ণ শেষ হয়নি!

লেখক : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

(AUGUST 14, 2018)

শেয়ার করুনঃ