ঢাকা উত্তরের কাস্তে মার্কার মেয়রপ্রার্থী ডা. আহাম্মদ সাজেদুল হক রুবেল-এর নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ ‘দক্ষ, কর্মসংস্থানবান্ধব, সমতাভিত্তিক, নিরাপদ ও বসবাসযোগ্য ঢাকার অঙ্গীকার’
আজ ২৬ জানুয়ারি ২০২০, রবিবার, সকাল সাড়ে ১১টায় পুরানা পল্টনস্থ মুক্তিভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে সিপিবি মনোনীত প্রার্থী ডা. আহাম্মদ সাজেদুল হক রুবেল তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ডা. সাজেদুল হক রুবেল দক্ষ, কর্মসংস্থানবান্ধব, সমতাভিত্তিক, নিরাপদ বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, এজন্য চাই বিকল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা, বিকল্প নেতৃত্ব, গণমানুষের প্রতিনিধি, পরিচ্ছন্ন ও নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি।
ডা. রুবেল বলেন, বাংলাদেশের রাজধানী আমাদের প্রিয় ঢাকা একটি ঐতিহ্যের শহর। দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির পরিচালনার কেন্দ্র। শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-খেলাধুলা-জ্ঞান, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা চর্চা আর উৎকর্ষের প্রাণ এই মহানগর। মানুষের মুক্তির লড়াই, সংগ্রাম, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের শহর। অথচ এখন ঢাকার কথা বললেই মানুষের কল্পনায় ভাসে অবাসযোগ্য, যানজট, ধূলা ও দূষিত বায়ু, মাত্রাতিরিক্ত শব্দ, অপরিকল্পিত স্থাপনা, আর ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-সম্প্রদায় নারী-শিশু ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য এক অনিরাপদ নগরীর ছবি।
তিনি বলেন, এতকাল বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাই নগরের মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ গরিব-মেহনতী-মধ্যবিত্ত মানুষকে বঞ্চিত করে তারা শাসক গোষ্ঠীর নিরবিচ্ছিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। গুলশান-বনানী-বারিধারার ডিপ্লোমেটিক জোনসহ গুটিকয়েক ধনীকশ্রেণীর বসবাসের স্থানসমূহ ছাড়া কোথাও তেমন কোনো নাগরিক সুবিধা নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠীর যেমন অর্থ সম্পদ তৈরি করে, ঢাকার নগরের মেয়ররাও এর কোন ব্যতিক্রম করেনি। এই শাসকগোষ্ঠী জনগণকে নির্মম বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ঢাকাকে সিঙ্গাপুর, লসএঞ্জেলস, ব্যাংকক বানানোর স্বপ্ন দেখিয়েছে। ফলাফল শূন্য। ১% লুটেরা বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠী বনাম ৯৯% শতাংশ জনগণের স্বার্থ। স্বার্থের দিকে তাকালে আমরা দেখি ১% রক্তচোষা শোষক লুটেরা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত আর সমাজের ৯৯% মানুষ শোষণের যাতাকলে পিষ্ট। অথচ আমরা ভোট দেই সেই ১% কেই।
এতকাল আমরা ভোট দিয়ে প্রতিদান হিসেবে পেয়েছি গ্যাস সংকট, যানজট, জলাবদ্ধতা, কালোধোঁয়া, খাদ্যে ভেজাল, উন্নয়নের নামে লুটপাট, নদী-খাল-জলা ভরাট ও দখল, ক্যাসিনো বাণিজ্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ হাজারো সংকট। তাই ভোট দেওয়ার পূর্বে ভাবতে হবে, কাকে আমরা মেয়র নির্বাচিত করছি? আদর্শবাদী, নিষ্ঠাবান, মেহনতি-গরিব-মধ্যবিত্তদের প্রতিনিধিকে নাকি ধনী-লুটেরা-শাসকগোষ্ঠীকে? সৎ-যোগ্য নাকি দুর্নীতিপরায়ণ-দখলদারের তাবেদার গোষ্ঠীকে? সমতা ও ন্যায্যতার ধারক নাকি শোষণকারীকে? প্রকৃত জনবান্ধব রাজনৈতিক নেতৃত্ব নাকি লুটেরা ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি-ব্যবসায়ীদেরকে? মুক্তবুদ্ধি চর্চার ধারক অসাম্প্রদায়িক শক্তি নাকি সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির প্রতিনিধিকে? বিকল্প শক্তি নাকি তথাকথিত বড় দল বলে পরিচিত চলমান বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার প্রতিনিধিকে? শুভ না অশুভ শক্তিকে। তিনি বলেন, এটাই সুযোগ পরিবর্তন শুরু করার।
ডা. সাজেদুল হক রুবেল তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা মহানগরীতে কর্মসংস্থানের বিকল্প প্রস্তাবনা, যানজট নিরসন, বায়ু দূষণ, জলাবদ্ধতা নিরসন, মশা নিধন, ঢাকা শহরকে সুবজ শহরে পরিণত, পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ-এর সমস্যা সমাধান, বিষমুক্ত খাবার ও ভেজালমুক্ত বাজার নিশ্চিত করা, বস্তিবাসী ভাসমান মানুষের সমস্যা সমাধান ও বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, নারী ও সকলের নিরাপত্তা বিধান, নগরবাসীর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসেবা নিশ্চিত করা, হকার ও রিক্সা সমস্যা সমাধান, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, প্রতিবন্ধীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান, পর্যটন নগরীর সুযোগ-সুবিধা বিধান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন গড়ে তোলা, খেলা-ধুলা, সংস্কৃতি চর্চা ও বিনোদনের নিশ্চয়তা বিধান করা, দুর্নীতি দূর ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, অসাম্প্রদায়িক ঢাকা গড়ে তোলা এবং সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য নগর সরকার প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সিপিবি কেন্দ্রীয় সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও বক্তব্য রাখেন। এসময় সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম, সহ-সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহির চন্দন, প্রেসিডিয়াম সদস্য ল²ী চক্রবর্তী, আব্দুল্লাহ ক্বাফী রতন, কেন্দ্রীয় সম্পাদক আহসান হাবিব লাবলু, সিপিবি নেতা আব্দুল কাদের, ডা. ফজলুর রহমান, জাহিদ হোসেন খান, কাজী রুহুল আমিন, লুনা নূর, যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ইশতেহারে বলা হয় সকলের কথা শোনা ও সেবা নিশ্চিত করতে সিটি কর্পোরেশনের দরজায় কোনো পর্দা থাকবে না। সকল ধরনের পর্দা খুলে ফেলা হবে। তিনি নগরীতে কর্মসংস্থান ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরির কর্মসূচি গ্রহণ, নগরের সকল নিম্নআয়ের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান ও রেশনিং-এর ব্যবস্থা করার অঙ্গীকার করেন। তিনি যানজট, জলজট নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেন। ঢাকার সকল খাল ও জলাশয় অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারোপযোগী করা, খালের দুই পাড়ে পায়ে চলাচলের রাস্তা তৈরি ও পরিবেশবান্ধব ফলজ গাছ লাগানোর কথা বলেন। তিনি ঢাকাকে মশামুক্ত করতে বছরজুড়ে কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর কথা বলেন। তিনি ভেজালমুক্ত বাজার ও বিষমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে শক্তিশালী ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেন। ভোক্তা ও উৎপাদনকারীদের সুবিধার জন্য কৃষকবাজার ও রাত্রিকালীন বাজার স্থাপনের কথা বলেন। তিনি বলেন, নগরীর সাধারণ মানুষের গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা ও বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে। নারীবান্ধব ও তাদের জন্য নিরাপদ শহর গড়ে তোলার অঙ্গীকার এবং নারীদের জন্য পৃথক গণপরিবহন চালুর কথা এবং ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কিশোরীদের আত্মরক্ষামূলক বিশেষ প্রশিক্ষণের কথাও বলেন। তিনি নগরীর পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেন। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা এবং সাংস্কৃতিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। বেদখল মাঠ উদ্ধার, মাদকমুক্ত করা, তরুণদের নৈতিক চেতনায় গড়ে তোলার কাজে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি প্রণয়নের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ধর্ম যার যার, কর্পোরেশন সবার’ এটি মাথায় রেখে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, নাগরিক সভা নিশ্চিত করতে কর্পোরেশনে ২৪ ঘণ্টা কল সেন্টার চালু করা হবে। সাধারণ জনগণের অভিযেগা শোনার জন্য তিন মাসে একবার মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের জনগণের মুখোমুখি করা হবে।
তিনি বলেন, ৮টি মন্ত্রণালয়ের ৫৬টি অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে বিভন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। পরিবেশবান্ধব প্রকৃত উন্নয়নের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান ও অধিদপ্তর সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠা আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, এবারের ভোটের লড়াই মূলত অশুভ শক্তির বিনাশে শুভ শক্তির জেগে ওঠার লড়াই। তিনি বলেন, রাজনীতির ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে একদিকে ভোট চোর, দুর্নীতি, স্বৈরাচারী দুঃশাসন ও অন্যদিকে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী জঙ্গীবাদী চক্রকে রুখতে; নিজস্ব শক্তি নিয়ে সাধারণ মানুষের সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, গত সাড়ে চার দশক ধরে ঢাকাকে কংক্রিটের শহরে পরিণত করা হয়েছে। যারা এই কাজ করেছে তাদের পাল্টাতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরকে সুন্দর করতে হলে অসুন্দর সৃষ্টিকারী কলঙ্কজনক নেতৃত্বকে বিদায় করতে হবে। অধিকাংশ মানুষের স্বার্থ বাদ দিয়ে নগরকে সুন্দর করা যাবে না। তিনি বলেন, সিপিবি’র প্রার্থী পরীক্ষিত। এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন মানুষের আন্দোলনের পরীক্ষিত মানুষ। এই মানুষকে নির্বাচিত করে দিন বদলের সুযোগ গ্রহণ করাই ঢাকাবাসীর কর্তব্য।