দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান প্রীতিলতার একজন সফল উদ্যোক্তা’র গল্প

সাভার গার্হ্যস্থ অর্থনীতি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান প্রীতিলতা। টিউশনি করেই লেখাপড়ার খরচ মেটাতেন। পরিবারকেও সহযোগিতা করতেন। কিন্তু গতবছর মহামারি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া শুরু হলে স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। এতে তার এই সামান্য আয়-রোজগারের পথটুকুও থেমে যায়। কিন্তু থেমে থাকেননি লড়াকু প্রীতিলতা।

পরিকল্পনা নেন উদ্যোক্তা হবার। টিউশনির চিন্তা পুরোপুরি বাদ দিয়ে করোনাকালের লকডাউনের সুযোগকে কাজে লাগালেন শৈশবের শখকে। বানালেন হ্যান্ডমেইড জুয়েলারি। শুরু করলেন পেইন্টিং। আর এই সময় বিক্রির জন্য বেছে নিলেন অনলাইন প্লাটফর্ম। ফেসবুকে খোলা পেজ ‘প্রীতিলতা’জ আর্টিস্ট্রি’ কয়েক মাসের মধ্যেই প্রসারিত হলো। বাড়লো শিল্পকর্মের চাহিদা। ধীরে ধীরে ফের ঘুরে দাঁড়াতে লাগলেন তিনি। প্রীতিলতার ভাষায়, ‘শৈশব থেকেই হস্তশিল্পের কাজে খুব আগ্রহ ছিল। স্কুলে পড়াবস্থাতেই লুকিয়ে চারুকলার প্রদর্শনীতে যেতাম। দেয়ালো টাঙানো শিল্পকর্ম খুব টানতো। ইন্টারনেট ঘেঁটে টুকটাক শিখলাম কাজ। মনের মাধুরি মিশিয়ে কাঠের ওপর, কাপড়ের ওপর ফুটিয়ে তুললাম শিল্পকর্ম। ফেসবুকে পোস্ট করলে বন্ধু-স্বজনরা প্রশংসা করতেন, কেউ কেউ জুয়েলারি, পেইন্টিং কিনতেও আগ্রহী হলেন।

সেখান থেকেই হাতে বানানো গহনা বানিয়ে বিক্রির পরিকল্পনা শুরু।’ শুরুতে মূলধন কতটুকু ছিল এমন প্রশ্নে প্রীতিলতা বলেন, ‘আমার আসলে সেরকম কোনো মূলধন ছিল না। একটা স্ক্র‍্যাপবুকের জন্য ৮০০ টাকা পেয়েছিলাম। সেটা দিয়েই শুরু। হ্যান্ডমেইড জুয়েলারির পাশাপাশি আমি পেইন্টিং সেল করার জন্য ট্রায়াল পোস্ট দেই। এরপর থেকে প্রতিনিয়তই পেইন্টিং এর অর্ডার আসতো।

আমি মেটালের গয়না বানানো শুরু করি, সেগুলো দিয়েও বেশ ইতিবাচক সাড়া পাই। যেহেতু আমি আমার নিজস্বতা বজায় রাখার একটা চেষ্টা করি। প্রীতিলতা তার সফলতার পেছনে ক্রেডিট দিতে চান সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে। তার ভাষায়, ‘আমার একাউন্ট, ফেসবুক পেইজ, ইন্সটাগ্রাম একাউন্ট থেকেই আমি আমার অর্ডারগুলো পাই। তাছাড়া বন্ধুরাও খুবই সহযোগিতাপ্রবণ, তারা প্রথমদিকে এটা ওটা অর্ডার করে আমাকে সে ধরনের কাজে পোর্টফলিও জমাতে হেল্প করেছে। আমি কখনো চাইনি আমার কাজের মানের চেয়ে অতিরঞ্জিত সাড়া পাবার, পোস্ট বুস্ট করারও চেষ্টা করিনি। তাই পেইজে রেস্পন্স পাই অন্যদের তুলনায় কম।’ যেটা শখ, যা আমাকে মানসিক প্রশান্তি দিচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে কাজ করলেও হাঁপিয়ে উঠছি না- এমন শখকেই পেশা হিসেবে নেয়া উচিত আছে বলে মনে করেন প্রীতিলতা।

তার ভাষায়, ‘শখের কাজটিই যদি আমার পেশা হয় আমি নিজের আগ্রহেই অনেক ধরনের আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে পারবো ৷ আমাকে জোর করে কিছু করতে হবে না। আমি অল্প কদিনের মানুষের সাড়া কারণই এটি।’ উদ্যোক্তা হতে গিয়ে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হয়েছে- জানতে চাইলে প্রীতিলতা জানান, ‘প্রথমদিকে দূরের ডেলিভারি করা একটু ঝামেলার ছিল, আয় অনেক কম ছিল। নিজে যেয়েই ডেলিভারি করা লাগতো অনেক সময় লেগে যেতে, প্রোডাক্টের অর্ধেক টাকা হয়তো যাওয়া আসার ভাড়াতেই চলে যেত! ডেলিভারি সার্ভিসে আসার পর এই চ্যালেঞ্জটা দূর হয়েছে।

আগে অর্ডার একেবারেই কম পেতাম, আমার ভালো ফোন না থাকায় ভালো ছবি তোলা হতো না। ফলে কাজের মান বোঝা যেত না। এখন তো আসলে ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশনের যুগ, দেখতে ভালো না হলে মানুষ আগ্রহী হবে কেন?’ ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে প্রীতিলতা বলেন, ‘আমি যা অর্ডার পাই,বা যা কিছু বিক্রি করি প্রতিটা জিনিস আমার হাতে বানানো। কিন্তু একা একা কাজ করে তো আর বেশিদূর যাওয়া সম্ভব না। আমার ডিজাইনার হওয়ার দিকেই ঝোঁক বেশি। আমার ইচ্ছা আমি একটি মানসম্পন্ন আর্ট ব্র‍্যান্ড প্রতিষ্ঠা করব।

আমার ইচ্ছা তৃণমূল পর্যায়ের সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের নিয়ে ট্রেইন করে এই ধরনের কাজে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া।’ তিনি বলেন, ‘নকশা, নির্দেশনা আমি দিব। আর তারা তাদের দক্ষতা দিয়ে সেগুলো প্রয়োগ করবে। যেমন হ্যান্ড ব্লক এর পোশাক, ইন্ডোর প্লান্টস এর পটারি পেইন্টিং, সূঁচিশিল্প । আর আমার ব্যক্তিগত ভাবে ইচ্ছে আমি প্যাটার্ন বা ডিজাইন ক্রিয়েট করব যেগুলো দিয়ে বিছানার চাদর, কুশন কভার, টেবিল ম্যাট, ওয়ালপেপার দেয়ালের লাগানোর স্টিকার যা দেখতে পুরো দেয়ালে রঙ করা হয়েছে বলে মনে হয় বা কোনো পণ্যের টেক্সচার ডিজাইন হবে। এনালগ আর্টকে ডিজিটাল প্লাটফর্মে নেয়ার বিষয়গুলোই শিখছি এখন।

শেয়ার করুনঃ