দূর্যোগে নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও রেশনিং ব্যবস্থা

সাম্প্রতিককালে করোনার মারাত্বক আক্রমনের কারণে মৃত্যুর উর্ধ গতি সবাইকে চিন্তিত করেছে, প্রতিদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ২১২ জনে এসে ঠেকেছে। আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা জুন মাসের শেষ দিক থেকেই বৃদ্ধি শুরু হয়েছিলো, এটি আরো বাড়তে পারে, বিশেষজ্ঞদের এমন ধারণার কারণে জুন মাসের শেষদিকে স্থানীয় পর্যায়ে জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে লক-ডাউন প্রদানের সিদ্ধান্ত সরকার দিয়েছিলেন এবং ২৭ জুন থেকে জাতীয়ভাবে সীমিতভাবে এবং ১লা জুলাই থেকে এক সপ্তাহ এবং পরে সেটা বাড়িয়ে ১৪ জুলাই পর্যন্ত করা হয়েছে।

সামরিক বাহিনী নিরাপত্তা বাহিনীসহ সিভিল প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তরা যেমন মাঠে দায়িত্ব পালন করছে সাথে সাথে অপ্রয়োজনে লোকজন যাতে ঘর থেকে বের না হয় সে জন্য জরিমানার পথ অনুসরণ করা হচ্চে। এই পরিস্থিবির মধ্যেও অপ্রয়োজনে কিছু লোক যেমন বের হচ্ছেন পাশাপাশি দরিদ্র শুমজীবী রিক্সা ভ্যান ও অটো চালকদের বের হতে দেখা যাচ্ছে ,তাদের বক্তব্য কাজ না করলে তাদের খাবার জুটবেনা, তাই তাদের বাধ্য হয়েই বাইরে বের হতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের পক্ষ থেকে খাদ্র সহায়তা দেওয়া হচ্ছে যদিও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে পণ্য সামগ্রী বিক্রির ব্যবস্থা করেছে, লোক জনের যেভাবে সমাগম হচ্ছে তাতে সামাজিক দুরত্ব বজায রাখার বিষয়টি হুমকির মুখে পড়ছে। তৃতীয় খাদ্য সকল প্রাণির বেঁচে থাকার রসদ ,ফুয়েল ছাড়া যেমন গাড়ী চলেনা তেমনি খাদ্য ছাড়া প্রাণি বাঁচে না,শুধু বাঁচার জন্যই নয় স্বাস্থ্য পুষ্টির জন্যও খাদ্যের প্রয়োজন। পৃথিবীব্যাপি যখন প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট কারণে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুকির মুখে সেখানে মানুষ ছাড়া অন্য প্রণির খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সভ্য ও উন্নত দেশগুলি সচেতন হলেও আমাদের মতো দেশগুলির নিকট সেটা চিন্তারও অতীত, জানিনা এ দৈন্যদশার সমাপ্তি কবে হবে?

করোনা যেমন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্যদশা সেইসাথে এ্যকাউনটিবিলিটির অভাবের চিত্র দেশবাসির নিকট দৃশ্যমান করেছে, সেইসাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার ঝুকির বিষয়টি পুনরায় সমাজের সামনে নিযে এসেছে।দূর্যোগ শুরু হতেনা হতেই নিম্ন বিত্তের মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা নিযে সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। ঘটনার সুত্রে কেউ এটাকে গজব কেইবা এটাকে পাপের প্রাশ্চিত্রবলে নতুন নতুন ফতোয়ার দেয়ার সুযোগ পায়। বিজ্ঞান ও দর্শনের জায়গায় হাজির করে ভাববাদকে,ভাববাদী দর্শনের উক্তি “যদি থাকে কপালে কি করবে গোপালে, অথবা কপালে আছে হাড় কি করবে চাচা খাজান্দের”(পরিশেনকারী), অর্থনীতি নামক সমাজ বিজ্ঞানের উক্তি চুড়ান্ত বিচারে করঘাত এবং করপাতের শিকার সাধারণ জনগণ। অর্থাৎ কর/খাজনা বাড়লে চূড়ান্ত বিচারে সেটা ভোক্তাকেই বহন করতে হয়।

বাস্তবেও সেই ঘটনাই ঘটেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে পশু শিকারের যুগ,পশু পালনের যুগ কৃষির যুগ এবং শিল্প বিপ্লবের যুগে এবং রাজনৈতিক ইতিহাসে আদিম সাম্যবাদী সমাজ সামন্তবাদী সমাজ জমিদারের সমাজ এবং পূজিবাদী সমাজ সব সময়েই সব ধরণের আপদ-বিপদের প্রথম শিকার হয়েছেন আর্থিকভাবে দুর্বল সেই শ্রমজীবী শ্রেণি এবং অসচেতন জনগোষ্ঠী নারি শিশু বয়স্ক মানুষ । পৃথিবীর প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি সাধারণ গরিব ও শ্রমজীবী যারা দিন আনে দিন খায় সেই জন গোষ্ঠীর যে দূর্যোগের মুখোমুখি হওয়া শুরু হয়েছে আজকের বিশ্বেও তাদের সেই অবস্থা থেকে মুক্তি ঘটেনি। যুগের পরিবর্তনের কারণে আদিম অবস্থা থেকে উন্নতর অবস্থানে এসেছে, সেইসাথে দূর্যোগের শ্রেণিচরিত্রেরও নতুন নতুন ডায়মেনশন সামনে এসেছে।

করোনার সময় চাল বিতরণ অনিয়মের কারণে শতাধিক জনপ্রতিনিদিকে (এর মধ্যে চেয়ারম্যান, মেম্বার, পৌর কাউন্সিলর, জেলা পরিষদ সদস্য) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে দেশের সরকার প্রধান পর্যন্ত এমনতর অবস্থায় বলতে বাধ্য হয়েছেন যে,কাফনের কাপড় দিলে ওরা মেরে খাবে,অসম্ভব কিছুই নয়, মসজিদ মন্দির ও গোরস্থানের নামে বরাদ্দকৃত অর্থও মেরে দেওয়ার নজির পূর্ব থেকেই আছে। মানবতার সেবা করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্বাস্থ্য/চিকিৎসা পেশায় আগতদের রোগীর প্রতি অসৌজন্যমুলক আচরণ, চিকিৎসা প্রদানে অবহেলা, অতিরিক্ত টাকা আদায় করার ঘটনা এই সকল মানুষদের জন্য নতুন নয়, তবে সবাই এ দলের নয়, কথায় বলে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। মানুষের সংকটের এই সময়ে সরকারি বেসরকারি দল, চিকিৎসা কেন্দ্র সেই সাথে সেগুলি পরিচালনাকারীদেরর আরও মানবিক মানবিক হওয়া দরকার।

ইতোমধ্যেই কিছুকিছু প্রাইভেট ক্লিনিং এর কার্যক্রম বন্ধ করা পেশার দিক থেকে এমনকি ববসায়ী নৈতিকতা থেকেও যেমন গ্রহণযোগ্য নয় তেমনি মানবিকতার দিক থেকেও উচিত নয়।বিষয়টি অনুধাবন করে সরকার প্রধান আপদকালীন এই সময়ে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব ¡পালনকারীদের জন্য ১০ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বীমার ঘোষণা দিয়েছেন, তবে তা কার্যকর হওয়া দরকার। মানবতা বিপর্যয়কারী করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের দেশের মৃত্যুর মিছিল যেভাবে দীর্ঘায়িত হয়েছে তাতে তৃতীয় বিশ্ব দেশ আতংকিত বেশি পরিমান। ফলে বঞ্চনার জায়গায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে সকল দূর্যোগ ঘটেছে তার প্রথম শিকার সহায় সম্বলহীন এবং অসেচতন জনগোষ্ঠীই। প্রাকৃতিক দূর্যোগই হোক আর সামাজিক/কৃত্রিম দূর্যোগই হোক উভয় ক্ষেত্রেই একই অবস্থা।

১৯১৪-১৯ সালের ১ম বিশ্ব যুদ্ধ ১৯৩৪-৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ, ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দা বা বাংলা ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ,১৯৯০ সালের ভয়াবহ বন্যাসহ সকল পর্যায়েই দরিদ্র জনগোষ্ঠী কষ্টের, মুখোমুখি হয়েছে। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী মধ্যে আবার যারা শারিরীক ভাবে ছোট বা দুর্বল সেইশিশু, নারী ও বৃদ্ধ জনগোষ্ঠর অন্তর্ভূক্ত থেকেছে। বিষয়গুলি অনুধাবন করে আপদকালীন সময়ে শিশুনারী ও বৃদ্ধ মানুষদের বিশেষ গুরুত্বের সাথে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে দেখার তাগিদ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে সেটা পালনের ঘটনা ঘটেছে। এই শ্রেণির মানুষ প্রথমেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার হোন,তাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষ থেকে খাদ্য সাহায্য নিয়ে মাঠে নামতে হয়, সরকারি খাদ্য সহায়তা নিয়ে চলে হরিলুট, ভুক্তভোগীরা হয় দান দখ্যিনার পাত্র। নিম্ন বিত্তের এই সকল মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যদি রেশনিং পদ্ধতি চালু করা যায় তাহলে সকলের খাদ্য নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করা সম্ভব সেই সাথে ত্রাণ-সামগ্যী লুটের নিন্দনীয় সংস্কুতি থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব।

রাজনৈতিক সহিংসতায় হরতাল ধর্মঘটে যানবাহন ও কলকারখানা বন্ধ থাকায় ডে-লেবার তথা শ্রমজীবী মানুষই কর্মহীন হয়ে আর্থিক সংকটের মুখে যেমন নিদারুন কষ্ট ভোগ করে তেমনি ঝড়,জলোচ্ছোস আর র্ঘর্ণিঝড়ে ঘর-বাড়িহারা হয়েছে, সাথে সাথে থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা সংকটের মুখোমুখি হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া চীনের উহান প্রদেশে করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত, মানুষের মৃত্যু পরবর্তিকালে পৃথিবীর ২১৫টি দেশে এই ভাইরাস প্রতিরোধে কোরেন্টাইন বা সংগ নিরোধ কর্মসূচিতে পৃথিবীব্যাপী লকডাউন পালিত হচ্ছে। জরুরি পরিসেবা স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, পানি ও খাদ্য দ্রব্যের দোকান ছাড়াই আর সকল ক্ষেত্রেই চলেছে লক ডাউন। এর ফলে পুরোপুরি বিশ্ব ব্যাপী মারত্মক ভাবে আতংকিত এবং সংকটে। সরকার এবং স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে আতংকিত না হয়ে সচেতন হওয়া, সংগ নিরোধ কর্মসূচি পালন করা, বারবার হাত পরিষ্কার করা, মাস্ক ব্যবহার করা, কোলাকুলি ও করমর্দন না করার আহবান জানানো হলেও মানুষ আশস্থ হতে পারছেনা, সেটা অনুসরণ করছেনা ফলে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। এমনকি চুপকরে ঘরে বসে থাকতেও অনেক ক্ষেত্রে পারছেনা।

মানবিক এই বিপর্যয়ের সময়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়েছে। করোনা প্রতিরোধের পাশাপাশি ব্যবসায়ী এই সকল দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রন করতে মোবাইল কোট পরিচালন করতে হবে। পৃথিবীতে যুগে যুগে মানুষের বিপদকে পূঁজিকরে এক শ্রেণির মানুষের স্বার্থ হাসিলের এই অমানবিকতার কথা জানা যায়, তবে মানবতার এই স্তরে এসে এ ধরনের অমানবিকতা সত্যিই কষ্টের। বিশ্বয়নের এ যুগে কোন সমস্যাই কোন একক দেশের একক সমস্যা নয়, এ সমস্যা সবার। তাই এ ধরনের সকল সমস্যা মোকাবিলায় সকল দেশের মানুষ ও শাসকদের উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। ধনিক, বণিক আর ক্ষমতাধর বড়-বড় দেশের শাসকরা এর প্রতিষেধক, প্রতিরোধক তৈরি করবে আর আমরা সেটা কিনে নিয়ে ব্যবহার করবো, এমন মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে, নইলে করোনার মত আরও নতুন কোন দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। সেইসাথে সাধারণ শ্রমজীবী যারা দিন আনে দিন থায় সেইসকল মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রেশনিং এর মতো বিকল্প চিন্তা করা জরুরি।

লেখকঃ আকমল হোসেন কলেজ অধ্যক্ষ, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদশে কলজে-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) কেন্দ্রীয় কমিটি, সিন্ডিকেট সদস্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া।

শেয়ার করুনঃ