কর্মস্থলে শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনসহ (এফবিসিসিআই) ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন হাইকোর্ট।
নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, কারখানার পরিবেশ ও মান উন্নয়নে ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রেখে আদালত বলেছেন, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাদের খুব পজিটিভ কোনো ভূমিকা দেখি না। তারা শুধু আছে কীভাবে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা নেবে, আর ব্যাংকঋণের টাকা মাফ পাওয়া যাবে। তাদের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি বা ফ্যাক্টরিগুলো যথাযথভাবে চলছে কি না, কোথায় কী দুর্বলতা ও ঘাটতি, তা দেখা উচিত।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ভুক্তভোগী শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা, ওভার টাইম ও ঈদ বোনাস পরিশোধ নিয়ে করা এক আবেদনের শুনানিতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের একক ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার এসব কথা বলেন। এই অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন রেখেছেন আদালত।
ওই অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫ কোটি এবং আহতদের ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনা চেয়ে ১০ জুলাই রিট করে চারটি সংগঠন। এগুলো হচ্ছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি।
রিটটি ১১ জুলাই শুনানির জন্য আদালতে ওঠে। শুনানি নিয়ে সেদিন আদালত রিট আবেদনকারীদের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারাও অপেক্ষা করেন। কোথায় কী হচ্ছে সজাগ থাকেন। ঈদের ছুটির পর নিয়মিত আদালত খুললে ক্ষতিপূরণসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে যথাযথ আবেদন নিয়ে আসতে পারেন। যেকোনো বিষয়ে জরুরি মনে করলে আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন। এরপর সম্পূরক ওই আবেদনটি করা হয়, যা আজ আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে আইনজীবী সারা হোসেন, নীনা গোস্বামী ও অনীক আর হক শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ও বিপুল বাগমার।
দুর্ভাগ্যজনক, ওভারসি নেই
শুনানিতে আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, হাসেম ফুডসের কারখানা শ্রমিকদের জুন মাসের বকেয়া এখনো দেওয়া হয়নি বলে তথ্য এসেছে। বোনাস ও ওভারটাইম হয়নি। আদালত বলেন, মঙ্গলবার থেকে শ্রমিকদের বকেয়া দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে পত্রিকায় দেখেছি। আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলা হয়েছিল, তাই দায়িত্ব আদালতকে জানানো।
আদালত বলেন, দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সে জন্য ধন্যবাদ। দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সুবিধা হয়। কর্তৃপক্ষের মধ্যে তৎপরতা থাকে। তখন সারা হোসেন বলেন, এই জায়গাটিতে আমাদের আস্থা যে আদালতের পর্যবেক্ষণে থাকলে কাজ হবে।
গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনের অংশবিশেষ তুলে ধরেন আদালত। এতে বলা হয়, বেতন দেওয়ার খবরে মঙ্গলবার রূপগঞ্জের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আলোচিত হাসেম ফুড লিমিটেডে ভিড় করেন হাজারো শ্রমিক। দুপুরের পর শ্রমিকদের জুন মাসের বেতন দেওয়া হয়। হাসেম ফুডসের সিনিয়র ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মুরাদ হোসেন বলেন, মঙ্গলবার আমরা জুন মাসের বেতন দিলাম। বৃহস্পতিবার ওভার টাইম এবং শুক্রবার ঈদ বোনাস দেওয়া হবে। আহত শ্রমিকেরা না আসতে পারলে তাঁদের পরিচয় দিয়ে স্বজনেরা বেতন নিতে পারবেন। যাঁদের পরিচয়পত্র হারিয়ে বা পুড়ে গেছে, তাঁদের আইডি নম্বর বললে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
আদালত বলেন, প্রক্রিয়া চলছে। কর্তৃপক্ষ এখানে তারিখ উল্লেখ করে বলে দিচ্ছে, কবে দেওয়া হবে।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দায়বদ্ধতা নেই
একপর্যায়ে আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনারা বিভিন্ন সংগঠন এসব (রিট বা আবেদন) নিয়ে আসেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে যে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এসব বিষয়ে কোনো ওভারসি নেই। এফবিসিসিআই স্টেটমেন্ট দিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুর ব্যাপারে শোক জানিয়েছে বা তাদের কোনো প্রতিনিধিদল সেখানে গেছে, এর মধ্যে দেখিনি। এসব ক্ষেত্রে এফবিসিআইসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি বা ফ্যাক্টরিগুলো যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, কোথায় কী দুর্বলতা, কোথায় ঘাটতি, তা দেখা উচিত।
ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই অফনেডেট। পত্রিকাগুলো প্রায়ই ফলো করার চেষ্টা করি, যে তাদের (সংগঠন) ভূমিকা কী? আসলে তাদের খুব পজিটিভ কোনো ভূমিকা দেখি না।
এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে উল্লেখ করে আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তারা শুধু আছে কীভাবে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা নেবে আর ব্যাংকঋণের টাকা মাফ পাওয়া যাবে। এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার জন্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর যে দায়বদ্ধতা—এ জায়গাগুলোতে আপনাদের কাজ করা উচিত।’
আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে বিজিএমই থেকেও যতটা উদ্যোগ দেখা গেছে, নিজেদের জাতীয় ও দেশীয় শিল্প—সে ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যায় না। আদালত বলেন, ‘আপনারা সজাগ থাকলে সবাই তৎপর হবে।’
রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহত শ্রমিকদের বোনাস ও ওভারটাইমের পরিশোধ বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি বিবেচনার আরজি জানান আইনজীবী সারা হোসেন। আদালত বলেন, ঘটনাটি সারা দেশের মানুষের মনে রেখাপাত করেছে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে, দেখা যাক। শুধু এই প্রতিষ্ঠান নয়, দেখেন অনেক প্রতিষ্ঠানে বোনাস নিয়ে হইচই আছে। আশা করি হয়ে যাবে।
আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানিয়ে আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, একজন চিকিৎসার খরচের বাইরে আছেন।
তখন আদালত বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে কে, কোন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ও সাহায্য পাননি, তা ই–মেইলের মাধ্যমে জানাবেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে জানানো হবে, এঁদের বিষয়ে যোগাযোগ করে যাতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।