ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী আমেজ তৈরি না হলেও কিছুটা আলোচনা চলছে। ১৬ জানুয়ারি ২০২০ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মনোনীত কাস্তে মার্কার প্রার্থী ডা. আহাম্মদ সাজেদুল হক রুবেলের সাথে গণসংযোগে থেকে তা বোঝা গেল। উত্তরা-আজমপুর-দক্ষিণখান এলাকায় এই গণসংযোগে কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক, দোকানদার, পথচারীদের সাথেই প্রধানত আলাপচারিতা হলো।
মানুষের মাঝে এখনও প্রধান প্রশ্ন, ‘ভোট হবে কি?’ ‘ফলাফল তো নির্ধারিত, কী করবেন আপনারা?’ ‘ইভিএমে তো নতুন ধরনের কারচুপি হবে!’ ‘মানুষ কি ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে?’ ‘আপনারা তো ভাল কথা বলেন, কেউ তো তা শুনে না’। হতাশার ছাপ সর্বত্র। নারী-কিশোর-যুব গার্মেন্টস শ্রমিকদের কয়েকজন প্রচারপত্র হাতে নিয়েই মন্তব্য করলেন, ‘বৃষ্টি হলেই কারখানার সামনের রাস্তায় হাঁটুপানি’– হাটতে পারি না। ‘রাস্তায় চলতে পারি না’–ভাঙাচোরা রাস্তা। ‘থাকি বস্তিতে, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ পাই না’, ‘আমাগো খবর কে রাখে?’ ‘ভোটের নামে জিতে তো লুটপাট করে’, ‘আমাগো কিছু হয় না’- এরকম অসংখ্য কথা। এসবের মধ্যেও সিপিবি নেতা রুবেল ও নিবেদিতপ্রাণ সিপিবি কর্মী-সমর্থকরা তাদের কথা, আহ্বান শুনিয়ে যাচ্ছেন ঢাকাবাসীকে।
ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতো এখনকার অন্যতম প্রধান কাজ। এজন্য আমরা লড়াইতে আছি। এ কাজে জনগণকে এগিয়ে আসার এবং পাড়ায় পাড়ায় ‘ভোট পাহারা কমিটি’ গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে। এখনকার ‘ভয় ও লোভের’ অপধারা, টাকার ও মার্কার খেলা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, সাম্প্রদায়িক আঞ্চলিক প্রচারণা আর প্রশাসনিক কারসাজি এবং আমাদের শক্তি ভারসাম্যের মধ্যে নির্বাচনী রাজনৈতিক সংগ্রামে কতটুকু পারা যাবে-তা সময়ই বলে দেবে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক কথার মধ্যে নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ঢাকা সিটির জন্য করণীয় কিছু কথা আমরা বিশেষভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরছি। মানুষের মতামত শোনার, বোঝার চেষ্টা করছি। যা আমাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমকে সমৃদ্ধ করবে।
১. বাস্তব কারণে সারাদেশের মানুষের চাপ রাজধানী ঢাকার ওপর। সংবিধানের ১৯নং অনুচ্ছেদে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা, প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা আছে। অথচ এ বিষয়ে অতীতে ও বর্তমান সরকারের আমলেও কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। সংসদ, কেন্দ্রীয় সরকার ও কিছু ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য এরা স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্ব দিতে চায় না। যার ফলে স্থানীয় উন্নয়নও ব্যাহত হয়। এ অবস্থা বজায় রেখে রাজধানীর ওপর মানুষের চাপ কমানো যাবে না। রাজধানী ঢাকাকে সচল করা যাবে না। তাই ঢাকার চলমান সমস্যা সমাধানের সাথে ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ’ এর দাবিতে আমাদের কণ্ঠ বরাবরের মতো সোচ্চার করতে হবে। এ বিষয়ে সচেতন ও পরিকল্পিত ভূমিকা নিতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। এর জন্য জাতীয় পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ঢাকাবাসীকেও এ বিষয়ে বুঝতে হবে, কণ্ঠ সোচ্চার করতে হবে।
২. উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য অর্থের বিষয়টি সামনে আসে। দেশের বাজেটের আকার বড় হলেও স্থানীয় কার্যক্রমে বরাদ্দের সময় টাকা নেই বা উন্নয়নের জন্য আরও টাকা দরকার এসব কথা সামনে এনে ট্যাক্স-ভ্যাট আরও বাড়িয়ে, নানা ফন্দি করে অধিকাংশ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আরও টাকা আদায়ের পথ খোঁজা হয়। আমাদের সংবিধানের ৫৯ নম্বও অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসনের কথা বলা হয়েছে। ইংরেজিতে বলা আছে, ‘Local Government’। ইংরেজির বাংলা অনুবাদ নিয়ে কথা থাকলেও ৫৯ (১) এ বলা হয়েছে, “আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ এ কার্যক্রমে মধ্যে, “জনসাধারণের কার্য ও ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের’ কথা বলা আছে। এসব বিবেচনা করে আমাদের সাধারণ দাবি হলো বাজেটের অন্তত এক তৃতীয়াংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত করা দরকার। এজন্য যথাযথ আইন প্রণয়নও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে স্থানীয় সরকার/শাসন উন্নয়ন কার্যক্রমে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে না। স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের দয়ায় তাকিয়ে থাকা বা কেন্দ্রীয় সরকারের তাবেদারিতেই সময় যাবে। উন্নয়নের কথা বলে মানুষের ঘাড়ে ট্যাক্স-ভ্যাটের বোঝা চাপাবে। আর বড় বড় প্রজেক্ট বাস্তবায়নের নামে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ঋণের বোঝা বাড়বে।
৩. উন্নয়নের কার্যক্রম সফল করার কথা বললে ঢাকার মত ২ কোটি মানুষের শহরের জন্য আরেকটি অপরিহার্য বিষয় হলো, কোন ব্যবস্থায় ঢাকা চলবে? মেয়র-কাউন্সিলরদের কার্যক্রম কতটুকু? বর্তমান নির্বাচনে মনে হয় মেয়রই সব। সব প্রচার-প্রচারণা প্রধানত ঐ পদ ও প্রার্থীকে ঘিরে। কিন্তু এই ঢাকার কার্যক্রমের সাথে ৭/৮টি মন্ত্রণালয় ও ৫৬টি সংস্থার কার্যক্রম জড়িত। যাদের ওপর ‘মেয়র’ বা সিটি কর্পোরেশনের কোনো কর্তৃত্ব নেই। এসব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সাথে সমন্বয় না করতে পারলে সিটি মেয়র কোনো কাজই করতে পারবেন না। শুধু ময়লা অবর্জনা পরিষ্কার, রাস্তার লাইটিং আর মশা তাড়ানোর মত কয়েকটি কাজই থাকে ‘মেয়র’র হাতে। (কাউন্সিলরদের কথা এই পর্বে আর আলোচনা নাইবা করলাম।) তাই পুরো ব্যবস্থাকে পরিবর্তন ছাড়া সব দায়িত্ব পালন করে ঢাকা সিটির কার্যক্রম পরিচালনায় সম্পূর্ণতা পায় না। বিশ্বের বিভিন্ন নগরের অভিজ্ঞতায় বলে, আমাদের ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার দিকে এগোতে হবে। অতীতে দু-একজন মেয়র নগর সরকারের কথা বললেও এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র প্রার্থীরা আর এ কথা বলেন না। সম্প্রতি বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ‘নগর সরকার’ ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছেন। তাই ক্ষমতাসীনদের কাছে এটি আর এজেন্ডায় আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমরা ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে সংগঠিত করেই এগোচ্ছি। এর জন্য প্রচলিত মেয়র কেন্দ্রিক ভোট ব্যবস্থাও পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে ‘সংসদীয় পদ্ধতি’র বিষয়টি। কাউন্সিলরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। তাদের মধ্যে থেকে ‘মেয়র’ নির্বাচিত করা হবে। নগরেও এ ধরনের পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। ‘কাউন্সিলররা ‘মিনি পার্লামেন্ট’এর সদস্যের মত দায়িত্ব পালন করবেন। বর্তমান ‘অফিস কেন্দ্রিক মেয়র কার্যক্রম’ পরিচালনা বাদ দিয়ে ওয়ার্ড ও মহল্লাকেন্দ্রিক জনমণ্ডলী নির্ভর ব্যবস্থায় কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সর্বত্র স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হবে প্রধান কাজ। ‘মেয়র’ এক্ষেত্রে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সব কাজে সম্পৃক্ত করার কাজকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচনা করে নেতৃত্ব দেবেন। ঢাকার উন্নয়নের কাজে জড়িত সব সংস্থা নগর সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে। ‘নগর সরকার’কে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পালন করা দায়িত্ব পরিত্যাগ করে ‘স্বেচ্ছাশ্রমে সেবামূলক’ সরকারে পরিণত করতে হবে।
৪. ঢাকার উন্নয়ন নিয়ে অনেক কথা হয়। প্রশ্ন হলো শুরু করা হবে কিভাবে? কোথা থেকে? কেউ কেউ বলছেন, ঢাকাকে সিঙ্গাপুর-হংকং বানাবেন। এককজনের চোখে ঢাকার উন্নয়কে একেকরকম করে দেখা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, মোঘল আমল থেকে ঢাকা ছিল বহিরাগতদের সম্পদ আহরণের কেন্দ্র। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনাফার বড় উৎস ছিল ‘মসলিন বাণিজ্য’। আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৫০ বছর পালন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অথচ রাজধানী ঢাকাকে সাধারণ মানুষের নিরাপদ শহরে পরিণত করতে পারিনি। এখনও দেখি ঢাকা শহর কিছু মানুষের লুটপাট আর শোষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আগে এখান থেকে বিদেশিরা সম্পদ লুট করে বিদেশে পাঠাতো। আর এখন আমাদের দেশের কিছু লুটেরা সম্পদ লুট করে বিদেশে পাঠায়। ঢাকাকে এরা লুটপাটের ক্ষেত্র বানিয়ে রাখতে চায়। তাই অনেকে ‘বড় প্রজেক্ট’কে সামনে এনে, উন্নয়নের চটকদার কথা বলে ঢাকা শহরকে ‘বড় লুটপাটের’ কেন্দ্র বানাতে চাইবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঢাকার উন্নয়ন অর্থ অধিকাংশ মানুষের স্বার্থের উন্নয়ন। এজন্য ঢাকার ৯০ শতাংশ শ্রমজীবী মেহনতি-মধ্যবিত্ত মানুষের উন্নয়নের কথা হিসেবে রেখে উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে শহরের অধিকাংশ মানুষকে অসুন্দর রেখে শহরকে সুন্দর করা যাবে না।
‘পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে উন্নয়ন ধারণা’ পরিত্যাগ করে ঢাকা শহরের প্রাকৃতিক গঠনকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ করতে হবে। এ কাজে সব নাগরিককে সম্পৃক্ত করতে হবে। সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ শহর গড়ে তোলায় রাজধানী ঢাকাকে শ্রমজীবী-শিশু-নারী-বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েও পরিকল্পনা করতে হবে। ‘নগর সরকার’ গঠনের আগে পুরো ঢাকার কার্যক্রমে উত্তর-দক্ষিণের সমন্বয় সাধন হবে অন্যতম কাজ। এ জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নিদের্শনা থাকতে হবে।
ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরকে দক্ষ, উৎপাদনশীল, কর্মসহায়ক, গণতান্ত্রিক, পরিবেশ সহায়ক, সমতাভিত্তিক শহরে পরিণত করার আন্দোলনে আমরা অবিচল। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে, নির্বাচনী সংগ্রামেও এসব কথাই আমাদের প্রতিনিধিদের কণ্ঠে সোচ্চারিত হচ্ছে।
লেখক : রুহিন হোসেন প্রিন্স , সম্পাদক, সিপিবি