প্যাকেট ভালো দিলে ফ্যাক্টরীগুলোর পরিদর্শন ভালো হয় : রাজেকুজ্জামান রতন

গত ৮ জুলাই ২০২১ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় অগ্নিকান্ডে নির্মমভাবে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। মৃতদের বড় অংশই শিশু শ্রমিক বলে আলোচনায় উঠে এসেছে। কারখানায় অগ্নিকান্ড ও দূর্ঘটনা এটাই প্রথম নয়, এর আগে তাজরিনসহ অসংখ্য দূর্ঘটনায় হাজারও মানুষের নির্মম মৃত্যু হয়েছে। এই সকল ঘটনায় আসলে দায়টা কার এবং এই ঘটনাগুলো কেন বারংবার সংঘটিত হয় সেসব নিয়ে আজ রবিবার (১১ জুলাই) একটি অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আইপিনিউজ এবং পরিবেশ বার্তার আয়োজনে উক্ত আলোচনাটি আইপিনিউজ এর ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি সম্প্রচারণ করা হয়। পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল’র সঞ্চালনায় আলোচনায় অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান, বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা রাজেকুজ্জামন রতন, হাফিজুল ইসলাম, সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী হাসান তারিক চৌধুরী, শিক্ষক ও গবেষক ফারহা তানজীম তিতিল, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট নূরুননবী শান্ত, আদিবাসী যুব নেতা অনন্ত বিকাশ ধামাই প্রমুখ।

আলোচনায় সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, এই ফ্যাক্টরীতে তিন হাজারের উপর শ্রমিক ছিল এবং তার অধিকাংশই ছিল শিশু।অন্যদিকে রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আছে- শ্রম মন্ত্রণালয়।তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হচেছ ডিপার্টমেন্ট অব লেবার। আর তারা দেখেন একটি ফ্যাক্টরীতে নিয়মিত কাজ কর্ম হয় কীনা, কারা কাজ করছে। আর আরেকটা হচ্ছে ইনস্পেকশন অব ফ্যাক্টরী এন্ড স্টাবি্লশমেন্ট, যারা নিয়মিত পরিদর্শন করে। আরেকটা হচ্ছে- দমকল বাহিনী, যারা দেখেন যে অগ্নি নির্বাপনের সুরক্ষাগুলো আছে কীনা। আর বিল্ডিং কোড মেনে চলা হচ্ছে কীনা তার জন্য আরেকটা প্রতিষ্ঠান।সরকারের এই প্রত্যেকটি অঙ্গ চ‚ড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নাকি তারা ব্যর্থ হওয়ার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত আছে বলেও প্রশ্ন রাখেন তিনি। তাছাড়া পরিদর্শনকারীদেরকে প্যাকেট ভালো দিলে কারখানা পরিদর্শন ভালো হয় বলেও অভিযোগ তাঁর।

তিনি আরো বলেন, এসবের জন্য দায় রাষ্ট্রের। আমরা দেখি মালিকের লোভ, সরকার বা রাষ্ট্রের অবহেলা এবং শ্রমিকের অসহায়ত্ব। দায়ভারের কথা বলতে গেলে মালিককে তো শাস্তি পেতেই হবে আর রাষ্ট্রকেও এখান থেকে রেহায় দেয়া যাবে না। সংঘটিত ঘটনাগুলোর মালিক এবং এই কারখানাগুলোর পরিদর্শকদের যথাযথ শাস্তি না হওয়ার কারণেই আমরা এই ঘটনাগুলো বার বার ঘটতে দেখছি বলে মনে করেন এই শ্রমিক নেত্।

নারায়নগঞ্জের শ্রমিক নেতা হাফিজুল ইসলাম বলেন, যে বিন্ডিংটিতে অগ্নিকান্ড ঘটেছে সেখানে কোনো বিল্ডিং কোড মানা হয়নি বলে বলেছে ফায়ার সার্ভিস। তাছাড়া এখানে নানা রকম দাহ্য পদার্থ ছিল।যেটা কোনো মতেই গ্রহনযোগ্য ও আইনসিদ্ধ নয়। আর নিচ তলায় যখন অগ্নিকান্ড হয় তখন নিচতলায় শ্রমিকরা বের হতে পারলেও অন্যান্য উপরের শ্রমিকদেরকে ঘোষণা করা হল ‘আগুন নিভে গেছে’ এবং তালাবদ্ধ করে রাখা হল। যার জন্য আমরা বলছি এটি একটা হত্যাকান্ড। এই কারখানায় মালিকককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা অনেকেই খুশি হয়েছি। কিন্তু এই মালিকরা গ্রেফতার হয় এবং তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে জামিনে বের হয়ে যায়। আর রুটিন মাফিব একটি তদন্ত কমিটি হয় এবং মালিক পক্ষের বা সরকারের পক্ষপাতিত্ব হয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি থেকে সুষ্ঠু তদন্ত আশা করা যায়না বলেও মনে করেন তিনি।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান বলেন, আমরা দেখছি প্রতিনিয়ত কারখানাগুলোতে বড় বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এখানে ক্ষয়ক্ষতিও ব্যাপক। এ ধরণের শিল্পকারখানাগুলো যখন তৈরী করা হয় তখন তারা যে নিয়মগুলো অনুসরণ করার কথা সেগুলো অনুসরণ করে না। আমরা ঠিকই প্রভিশন রাখি কিন্তু বাস্তবে সেগুলো মানি না। এগুলোর ব্যর্থতা প্রথমে মালিকের তারপর যারা এগুলো দেখভাল করে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে সরকারের অন্যান্য বিভাগগুলির দায় অবশ্যই রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কীভাবে বের হবো তার একটা নির্দেশনা আছে, সেগুলো মানা হয়নি। যে কারখানায় অগ্নিকান্ড ঘটেছে, সেটা তো আমের জুস তৈরীর কারখানা। কিন্তু কোনো সাংবাদিক বলে নাই সেখানে কোনো আম পাওয়া গেছে।তার মানে সেখানে ক্যামিকেল ছিল এবং সেগুলো দাহ্য। ফায়ার সার্ভিস এই বিল্ডিং এর ছাড়পত্র দিয়েছে কীনা এগুলো জানা প্রয়োজন। আর এত দুর্ঘটনার পর আমরা দেখি একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় কিন্তু সে তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ জনসমক্ষে তুলে ধরা হয় না এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয় না বলে এগুলো বারংবাং ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।

এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ সরকারের ১২ টি প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র বা অনুমতি লাগে একটি ফ্যাক্টরী চালাতে। কিন্তু এই ফ্যাক্টরী কীভাবে ছাড়পত্র পায়। এমন একটি রাষ্ট্রে বসবাস করছি যেখানে পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদ মালিক পক্ষকে রক্ষা করে। আদালতের প্রসেডিং ও ভারডিক্ট কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুর্নিতীবাজ রাজনীতিবিদরা তাদের রক্ষা করে বলেও মত তাঁর।

তিনি আরো বলেন, শ্রম আইনের ৬২ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে ফ্যাক্টরীতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং বহির্গমনের পথ থাকতে হবে।আর ৬২(৩) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে আগুন লাগলে বহির্গমনের পথ বন্ধ করা যাবে না, তালাবদ্ধ কার যাবে না। কিন্তু সেজান জুস কারখানায় এটা মানা হয়নি।এছাড়া বাংলাদেশে অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন করাপ্টেড এবং সুবিধাবাদী ট্রেড ইউনিয়নের কারণে প্রকৃত শ্রমিক বান্ধব ট্রেড ইউনিয়ন তৈরী হচ্ছে না। শ্রমিকরা বার বার প্রতারিত হচ্ছে বলেও মত তার। ফলে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের লড়াই লড়তে হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে এবং বিপ্লবী ধারার সৎ ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত ন াহচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধরণের ঘটনা ঘটতেই থাকবে বলেও মনে করেন তিনি।

কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট নূরুননবী শান্ত বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি সমস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে এত গলদ ও দুর্নীতি এত গভীরে প্রবেশ করেছে কাকে দায়মুক্ত করবো তা আমরা খুঁজে পায়না। কেবলমাত্র গত ছয় বছরে বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা গুলোতে ৬০৮১ টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তারপরও এগুলো বারংবার ঘটছে । কেননা, যখন একটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে, যাদের মৃত্যুবরণ করতে হয় তারা ক্ষমতাহীন মানুষ। আমরা এমন একটি উন্নয়নের পথে হাটছি যেখানে যেমন করেই হোক টাকা আয় করতে হবে। সেটা মানুষকে মেরে ফেলে হোক। যেটা জিডিপি বা প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও একই।

গবেষক ও কষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি এসবের পেছনে দায়টা মালিক পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের দিকে চলে যাচ্ছে। রাষ্ট্র এবং তার সংস্থাগুলি কেউ ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। এই বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে কেউ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছি না এবং করতে চাইলেও পারা যাচ্ছে না। আমরা চারপাশে কোনো ধরণের নিয়ম ও ন্যায়্যতা দেখতে পাচ্ছি না। যদি দেখতে পাই সেটা খুব ক্ষীণ ধারায় বলেও মনে করেন তিনি। অল্প কিছু মানুষ প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করে টাকা রোজগার করবে আর তারা যাদেরকে ভর করে টাকা রোজগার করছে তাদেরকে মানুষ মনে করছে না বলে মনে করেন তিনি। এটা তাদের জন্য উন্মাদের একটা জায়হায় পরিণত হয়েছে এবং আমরা এসব বলে তাদেরকে ছেড়ে দিতে পারি না।

আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামাই বলেন, এত বছর এই কারখানার ভবনটি চলছে যথাযথ অনুমোদন ছাড়া। আর সরকারের যে সংস্থাগুলো পরিদর্শন করে তারা আসলে কী করছে। আর দুর্ঘটনার পর এতগুলো মানুষ মারা গেল এবং এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নারায়নগঞ্জের পুলিশ ব্যানার কেড়ে দিচ্ছে।তা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকদের পরিবার এবং আহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব বলেও মনে করেন এই যুব নেতা।

উক্ত আলোচনা থেকে আলোচকরা নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো তুলে ধরেন-

১, পূর্বেকার দুর্ঘটনাগুলোতে সংঘটিত হত্যাকান্ডগুলোর বিচার করতে হবে যাতে এসবের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তাই দায়ীদের যথাযথ বিচারের আওতায় আনা আর কারখানাগুলোতে যে শিশু শ্রমিকরা কাজ করছে সে বিয়য়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করা।
২. বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ কমপক্ষে ১৫ লক্ষ টাকা যেন দেয়া হয়।
৩. ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ আছে তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং একই সাথে শ্রমিকদের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল তৈরী করা।
৪. প্রচললিত শ্রম আইন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। এটার আমুল পরিবর্তনের করতে হবে।
৫. উন্নয়ন পরিকল্পনা ও লক্ষমাত্র মুনাফা কেন্দ্রিকতা থেকে ছড়িয়ে মানুষ কেন্দ্রিক করা।
৬. বিচার বিভাগকে কাজ করার জন্য স্বাধীন করে দিতে।
৭. ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও দুর্নীতিবাজদের যে আঁতাত তৈরী হয়েছে তা ভেঙ্গে দিতে হবে।
৮. মালিক ও সরকারের যে ১২ টি প্রতিষ্ঠান এসবের জন্য দায়ী ও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহীতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
৯. এইসব ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত না করে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

শেয়ার করুনঃ