কারখানায় ভরপুর ক্রয়াদেশ

করোনা চ্যালেঞ্জের কারণে যে অন্ধকার নেমে এসেছিল, তা কেটে যাচ্ছে। বদৌলতে ঝলমলে আলোর দেখা পাচ্ছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের পোশাকের জন্য প্রচুর ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত তৈরি করার বুকিং পেয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ সক্ষমতার চেয়েও বেশি।

পোশাকশিল্প খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানালেন, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। ফলে ওই সব দেশের ব্র্যান্ডগুলোর প্রত্যাশা, আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে পোশাক বিক্রি হবে। সে জন্য তারা প্রচুর ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনা শাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তার আগে থেকেই কিছু ক্রয়াদেশ চীন থেকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করে আসছেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় বর্তমানে ৫-১০ শতাংশ বেশি ক্রয়াদেশ আসছে। ফলে দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিক নিয়োগ বেড়েছে।

তবে পোশাক বিক্রির আদেশ বাড়লেও চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট ও দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন রপ্তানিকারকেরা।
গ্রীষ্ম ও বসন্তের আগে রয়েছে শীত মৌসুম। এই মৌসুমের ক্রয়াদেশও মোটামুটি ভালো পাওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি গত এপ্রিল থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশ থেকে মোট ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের (২ লাখ ৬৭ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা) পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি কমে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলার হয়েছিল। ওই অর্থবছরের শেষ তিন মাস মহামারিতে বিপর্যস্ত হলেও সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের পুরোটাই ছিল করোনাময়। তারপরও এই অর্থবছরে ভালো করেছে বাংলাদেশ।

কারখানায় ভরপুর ক্রয়াদেশ

দেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি স্প্যারো অ্যাপারেলস।
দেশে চারটি ছাড়াও জর্ডানে তাদের যৌথ মালিকানায় একটি কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বছরে তাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ২০ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস) ও গ্যাপের অন্যতম বৃহৎ পোশাক সরবরাহকারী স্প্যারো অ্যাপারেলস।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম বলেন, ‘আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের পোশাকের জন্য ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত আমাদের কারখানায় পূর্ণ সক্ষমতা অনুযায়ী ক্রয়াদেশ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। তাতে ২০১৯ সালের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি ক্রয়াদেশ পাওয়া যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে গ্রীষ্ম শুরু হয়েছে। আর ইইউতে শুরু হবে ১৯ জুলাই। এই মৌসুমের জন্য ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকের চেয়ে
৮-১০ শতাংশ পোশাক কম ক্রয়াদেশ দিয়েছিল। টিকার কল্যাণে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় পোশাকের চাহিদা বেড়ে গেছে। সে জন্য অপ্রত্যাশিতভাবেও আমরা কিছু বাড়তি ক্রয়াদেশ পেয়েছি। উড়োজাহাজে কাপড় এনে কারখানায় পোশাক বানিয়ে আবার উড়োজাহাজে পাঠাতে হচ্ছে।

চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড বিশ্বখ্যাত অনেক ব্র্যান্ডের ডেনিম পোশাক প্রস্তুত করে। করোনার শুরুতে একাধিক ব্র্যান্ড সাময়িকভাবে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করলেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ইতিমধ্যে যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ পেয়েছে, তাতে আগামী মার্চ ও এপ্রিল পর্যন্ত দম ফেলার ফুসরত পাবেন না তাদের শ্রমিকেরা। বাড়তি ক্রয়াদেশের কারণে গত মাসে নতুন ২০০ শ্রমিক নিয়োগ করেছে ডেনিম এক্সপার্ট। আগামী মাসেও নতুন করে ২৫০-৩০০ শ্রমিক নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ডেনিম এক্সপার্টের এমডি মোস্তাফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি হওয়ায় সেখানকার ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে। কারণ, চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে আনছে অনেক ব্র্যান্ড। সেই তুলনায় ইইউ থেকে বাড়তি ক্রয়াদেশ আসছে না। তবে কয়েক মাসের মধ্যে সেটিও হবে। তিনি বলেন, ‘ক্রয়াদেশ এলেও পোশাকের দাম তুলনামূলক কম দিচ্ছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। এ জন্য অবশ্য আমরা কারখানা মালিকেরাই দায়ী। একজন আরেকজনের চেয়ে কম দামে ক্রয়াদেশ নিয়ে নিচ্ছেন।

তাই বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পোশাকের ন্যূনতম দাম বেঁধে দেওয়া দরকার।’
পোশাকের দাম নিয়ে বিপদে আছেন নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশনের মালিক মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘ছোট, মাঝারি ও বড়—সব কারখানাতেই প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। তবে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই বাড়তি খরচ দিতে চাইছে না। ইইউর এক ব্র্যান্ডের সাড়ে সাত লাখ পিস টি-শার্টের ক্রয়াদেশ নিয়ে আমার প্রতিষ্ঠানের দর-কষাকষি চলছে। প্রতিটি টি-শার্টের উৎপাদন খরচ ১ ডলার ৮৫ সেন্ট হলেও তারা দিতে চাইছে ১ ডলার ১০ সেন্ট। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের সুতার দাম কেজিতে ৭০-৮০ সেন্ট কম। সেই সুতার দাম দিয়ে উৎপাদন খরচ হিসাব করেও ক্রয়াদেশ নিতে পারছি না।

উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তাও আছে

কারখানায় প্রচুর ক্রয়াদেশ আসার পাশাপাশি গত শুক্রবার একটি ইতিবাচক খবরও পেয়েছে পোশাকশিল্প। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ওয়াল্ট ডিজনি আবার এ দেশ থেকে পোশাক কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা সরিয়ে নেয়। তখন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশি কারখানা থেকে বছরে ৫০ কোটি ডলার বা ৪ হাজার কোটি টাকার পোশাক কিনত।
এসব ভালো খবরের মধ্যে রপ্তানিকারকদের দুশ্চিন্তা কিন্তু কম নয়। কারণ, রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকছে দিনের পর দিন। প্রতিদিন কনটেইনারে পণ্য রপ্তানি হলেও সংকট কাটছে না। কারণ, যে পরিমাণে পণ্য প্রস্তুত হচ্ছে, তা পরিবহনে কনটেইনার পাওয়া যাচ্ছে না। আবার জাহাজেও চাহিদা অনুযায়ী কনটেইনার পরিবহনের বুকিং মিলছে না। গত শনিবার পর্যন্ত ১৯টি ডিপোতে পণ্যবাহী কনটেইনার ছিল ১৩ হাজার ৫৬০টি। কনটেইনার বোঝাইয়ের অপেক্ষায় শেডে ও গাড়িতে ছিল আরও বিপুল পণ্য।

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি মাসে পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে কয়েক দিন কারখানা বন্ধ থাকবে। আশা করছি, আগস্ট থেকে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বেশ বাড়বে। আগামী দিনেও সেটি অব্যাহত রাখতে আমাদের তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এক. করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শ্রমিকদের দ্রুত টিকার আওতায় আনা। দুই. চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ও জাহাজ-সংকটের সমাধান খুঁজে
বের করা। তিন. ব্যবসার খরচ কমাতে হবে। করোনা সংকটের কারণে ঘাটে ঘাটে খরচ বেড়ে গেছে আমাদের।

শেয়ার করুনঃ