করোনার কারণে গত মার্চে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার পরিস্থিতিতে মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। পরে তহবিলটির আকার বেড়ে ৯ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানামালিক নামমাত্র সেবা মাশুল বা সুদে ঋণ নিয়ে চার মাসের মজুরি দেন। দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানিতে গতি ফিরলেও হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেন গার্মেন্ট মালিকরা। তার আগে এপ্রিলে কারখানা বন্ধের সময়ে ৩৫ শতাংশ মজুরি কম দেন। এমনকি শ্রমিকের ঈদ বোনাসও কম দিয়েছেন অধিকাংশ মালিক। অথচ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে শ্রমিকেরা উৎপাদন করছেন, তাঁদের তো সুপার ইনক্রিমেন্ট দেওয়া দরকার। সারা বছর যে মূল্যস্ফীতি হয়, সেটি সমন্বয় করার জন্যই ৫% ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৫.৭৮%। সুতরাং মজুরি ৫% বাড়লেও মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি সমন্বয় হবে না।
করোনার কারণে গত মার্চের পর কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছিল তবে কয়েকটি কারখানা বাদে বেশীর ভাগ কারখানা চালু হয়েছে। বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারী শ্রমিকদের প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকের কাজের দক্ষতা থাকলেও তাদের ৬ নং গ্রেডে দেওয়া হচ্ছে। যে সব শ্রমিকের বয়স ৩৫ বছর পার হয়ে গিয়েছে তাদের বিভিন্ন কৌসলে চাকুরী চ্যুত করা হচ্ছে, তারা আর কোথাও চাকুরী পাচ্ছেনা, পরিবারের বোঝা হয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারনে শ্রমিক সংগঠন গুলোর সাংগঠনিক কার্ষক্রম অনেকটা কমে যাওয়ার কারনে করোনা ভাইরাসের সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের উপর নির্যাতন অনেক বেড়ে গিয়েছে। কিছু কিছু কারখানায় মাতৃত্বকালীন সুবিধা দেওয়া হচ্ছেনা, তিন জন শ্রমিকের কাজ দুই জন শ্রমিককে দিয়ে করানো হচ্ছে, কিছু কিছু কারখানায় শ্রমিকদের উপর শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন বেড়ে গিয়েছে। শ্রমিকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক সাদা কাগজ-রিজাইন পেপারে স্বাক্ষর নিয়ে চাকুরী চ্যুত করা হচ্ছে এবং তাদের পাওয়া দেওয়া হচ্ছেনা। নারী শ্রমিকরা কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে ধর্ষণ পর্যন্ত সিকার হচ্ছে।
ডিইপিজেডের লেনী ফ্যাশন, শাহীন ফ্যাশন, রিংসাইন ট্রেক্সটাইল লিঃ, এ-১ বিডি লিঃ, বেক্সিকো গার্মেন্ট লিঃ ও আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর এলাকার কয়েকটি কারখানা অডার বাতিলের কথা বলে কারখানা বন্ধ রেখে শ্রমিকদের আইগত পাওনা না দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। শ্রমিকরা লাগাতার আন্দোলন করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছেনা। শ্রমিকরা কারখানার গেইটে জড়ো হওয়ার সুযোগ দিচ্ছেনা। কোথাও জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের উপর স্থানীয় পুলিশ ও ঝুট ব্যবসায়ীদের দিয়ে শ্রমিকদের উপর হামলা করানো হচ্ছে।
শ্রমিকরা কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তাদেরকে ছাঁটায় করে দেওয়া হচ্ছে। কালিয়াকৈর এলাকার আগামী ফ্যাশনে ৫০ জন ও ইনক্রিডিবল কারখানায় ১৫০ জন, আশুলিয়া এলাকার সেতারা গার্মেন্ট ১০০ জনসহ বিভিন্ন কারখানায় চাকুরী চ্যুত করা হয়েছে।
কারখানা গুলোতে শ্রমিকদের যথাযত ভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই করোনার ঝুঁকি নিয়ে চলছে। শ্রমিকদের মধ্য করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণের তেমন আগ্রহ নেই তেমনি মালিকদেরও শ্রমিকদের করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার কোন উদ্যোগ নেই।
করোনার কারণে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় গত এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। পরের মাসে ১২৩ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়। তারপর রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ১ হাজার ৮৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র দেড় শতাংশ কম। বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে মালিকদের দর-কষাকষি না করে শ্রমিকদের ঘাড়ে পুরোটা চাপিয়ে দেওয়ার এই মানসিকতা কাঙ্ক্ষিত নয়। কাজ হারানো হাজারো শ্রমিকের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্ট কারখানা।
লেখকঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র