দক্ষিণ এশিয়ার বঞ্চনা দূর করতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা জনগণের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে-স্যাপি

আজ ৩০ জানুয়ারি ২০২১ তারিখ শনিবার সকাল ১১টায় সাউথ এশিয়ান অ্যালান্স ফর পভার্টি ইরাডিকেশন (স্যাপি) -বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের ও ফাইট ইন ইকুয়ালিটি অ্যালান্স, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, ইনসিডিন বাংলাদেশ, ভয়েস, জনউদ্যোগ ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার বৈষম্য পরিস্থিতি ও করণীয় (Inequality Situation in South Asia and Way Forwad) শীর্ষক এক ওয়েবইনার-এর আয়োজন করা হয়।

সাউথ এশিয়া অ্যালান্স ফর প্রভার্টি ইরাডিকেশন (স্যাপি)-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ফাইট ইনইকুয়ালিটি অ্যালান্স-এর বাংলাদেশের ফোকাল ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক ও নারীনেত্রী রোকেয়া কবীরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ওয়েব ইনারে করোনাকালীন বৈষম্য ও অসমতা বিষয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপনা করেন অক্সফামের পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ক্যাম্পেইন এবং কমুনিকেশন প্রধান এসএম মঞ্জুর রশিদ। করোনাকালীন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপনা করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ, করোনাকালীন স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন বিএমএ- এর সাবেক সভাপতি ডা. রশিদ-ই-মাহবুব, করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণের ভূমিকা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন জনউদ্যোগের আহবায়ক ডা. মুশতাক হোসেন। এছাড়া আরও বক্তব্য রাখেন শ্রমিক নেতা খায়রুল মামুন মিন্টু, ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আইইডি-র নির্বাহী পরিচালক নূমান আহম্মেদ খান, ইনসিডিন বাংলাদেশ-এর পরিচালক ও স্যাপির কোর কমিটির সদস্য এ কেএম মুশতাক আলী, আদিবাসী নেতা চঞ্চনা চাকমা, সলিডারিটির প্রতিনিধি মোর্শেদ বদরুন্নেসা,শ্রমিকনেতা অরবিন্দ ব্যাপারী, হেক্স বাংলাদেশের ছাইবুন প্রমুখ। এছাড়া আরও অংশ নেন আদীবাসী নেতৃবৃন্দ, কৃষক-শ্রমিক-ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ।

রোকেয়া কবীর বলেন, সারা বিশ্বে মহামারি পরিস্থিতি তৈরি করা এই ভাইরাসটি তার সংক্রমণ থেকে মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের জীবন যাপনের উপরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে । দরিদ্র মানুষগুলো আরও দরিদ্র হচ্ছে এবং তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে, বিশ্বায়নের ফলে সকল সুযোগ সুবিধা ও মুনাফার বেশির ভাগগুলোই ভোগ করছে ধনী দেশ এবং ব্যক্তিমালিকাধিন কোম্পানিগুলো, দক্ষিণ এশিয়ার বঞ্চনা দূর করতে এই প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে হবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা জনগণের কল্যাণে ব্যয় করার ব্যবস্থা গ্রাহন করতে হবে।

ভয়েস-এর নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন- দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠী জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও লিঙ্গ নির্বিশেষে বৈষম্যের শিকার। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালীরা এমন ধরনের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা ও ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেখানে বাজার ও অর্থের একচ্ছতর আধিপত্য। মূলত,এই বিষয়গুলোর ফলেই বিগত ৩০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় বৈষম্য চরমভাবে বেড়েই চলেছে। ফাইট ইনইকুয়ালিটি অ্যালায়েন্সের সদস্যসহ মানবাধিকার সংগঠন ও ব্যক্তিসমূহ প্রতিবছর জানুয়ারিতে একটি গণজমায়েত করে এবং বিশ^ব্যাপী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আহবান জানায়। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধারা ২৩-৩০ জানুয়ারি ২০২১ মেয়াদকালে একত্রিত হয়ে, জনগণের শক্তির জায়গাগুলো বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবেন এবং সরব কণ্ঠে উচ্চরণ করবেন (People’s Solutions are better than Davos’’)

বিএমএ-র সাবেক সভাপতি ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন- কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি বিপর্যয় ঘটে এবং দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে । করোনায় আক্রান্ত হলে তারা কিভাবে সেবা পাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার তৈরির পাশাপাশি, যাদের করোনা হয়নি কিন্তু অন্য জরুরী স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োজন তাদের পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এপরিস্থিতি মোকাবেলায় সকল প্রকার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহসহ করোনা ভ্যাক্সিন সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে।

অক্সফামের পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ক্যাম্পেইন এবং কমুনিকেশন প্রধান এসএম মঞ্জুর রশিদ বলেন, করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ও বৈষম্য কমাতে কমপক্ষে আগামী দুই বছরের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চত করতে সরকারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কৌশল নিরূপণ,বাজার ও সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দিক নির্দেশনায় কার্যক্রম ও নীতি নির্ধারণ নিশ্চিত করতে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা প্রক্রিয়া চালু করায় বিশেষ করায় প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা মোবাইল বা ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এক্ষেত্রে প্রান্তিক শিক্ষার্ধীর কাছে এই সুবিধাগুলো গৌছানো ব্যবস্থা করতে হবে।যারা চাকুরী হারিয়েছে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন ।
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন- বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠী জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও লিঙ্গ নির্বিশেষে বৈষম্যের শিকার। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালীরা এমন ধরনের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা ও ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেখানে বাজার ও অর্থের এক”ছত্র আধিপত্য। মূলত,এই বিষয়গুলোর ফলেই বিগত ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বৈষম্য চরমভাবে বেড়েই চলেছে যা করোনাকালে তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ ইনফরমাল সেক্টরে কাজের সাথে যুক্ত এবং ১৫% জনগনের গড় মাথাপিছু আয় ৫০০ টাকার কম। দেশে নতুন দরিদ্র জনগনের সংখ্যা এক কোটি চুরাশি লক্ষ। করোনা কালীন শহুরে কর্মজীবিদের আয় ৬০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে যেখানে গ্রামে হ্রাস পেয়েছে ১০ ভাগ (বিআইডিএস সার্ভে) । করোনা ভাইরাসের প্রভাব ৯৫ ভাগ মানুষের গড় আয় হ্রাস পেয়েছে। ৩% মানষের চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই। অপরদিকে ৭২% দীনমজুর তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে।এপরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষক সম্প্রদায় ও শ্রমজীবি মানুষের জীবনযাত্রা টিকিয়ে রাখতে সার্বিক বিবেচনায় তাদের জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চত করার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় আনতে হবে এবং তদানুযায়ী মাণদন্ড নিরূপণ করতে হবে। বিগত কয়েক দশক ধরে নারীরা গার্মেন্টস শ্রমিকসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে জীবিকা অর্জন করছে। সাধারণ ছুটির ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাজার ব্যবস্থা এবং পর্যটন শিল্পে যে ক্ষতি হয় তার সম্মুখ সারিতে আছে দরিদ্র নারীগন। কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় তারা কর্মহীন হয়ে পরে এবং গ্রামে ফিরে যায়। ফলে তারা অর্থনৈতিক সংকটসহ নানারকম মানবিক সংকটে পড়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে, ঠিক একইভাবে বাল্য বিবাহের সংখ্যাও বাড়ছে, বাড়ছে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ। দীর্ঘদিন বিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার কারনে কিশোরী মেয়েরা বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছা । এই পরিস্থিতি একদিকে যেমন নারী শিক্ষাকে প্রবলভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে . তেমনি বাল্যবিয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুন। পাশাপাশি নারীর ক্ষতায়নকে কয়েক যোজন পিছিয়ে দিচ্ছে । এপরিস্থিতিতে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর নারীর অবস্থা বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ।

জনউদ্যোগের আহবায়ক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি জনগণকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, সামাজিক সহায়তা ও জনভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভবপর নয়। ইনসিডিন বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মুসতাক আলী বলেন , ধনী এবং দরিদ্রদের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, মজুরী বৈষম্য কমানো, নারীর প্রতি বৈষম্য কমানো,দেশীয় কর রাজস্ব সচল করা এবং ধনী ব্যক্তি ও কোম্পানির প্রতি অন্যায্য কর ছাড় বন্ধ করা,ধনী ব্যক্তি ও কোম্পানির ন্যায্য ভাগ পরিশোধ করা; জনস্বাস্থ্য শিক্ষা, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিনিয়োগ করা, দায়িত্বশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলা এবং সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, নারী ও ক্ষুদ্র কৃষকের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাধান্য খর্ব করাসহ খাদ্যের ভ্যালু চেইনের শোষণ থেকে নারী ও ক্ষুদ্র কৃষককে রক্ষা করা, করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত/আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ , কার্যকর কর্মদক্ষতা নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রে গুড গভার্নেন্স নিশ্চিত করতে হবে।

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *