শ্রমিকদের ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসিকের ৫০ শতাংশ মহর্ঘ ভাতা প্রদান করুন।

প্রথম আলো সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম করোনার অজুহাতে আগামী দুই বছর শ্রমিকদের ৫% ইনক্রিমেন্ট দিতে চায় না মালিকদের একটি সংগঠন। এ জন্য তারা শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে।ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিভিন্ন খাতে যেখানে বেতন-ভাতা কমানো হয়েছে, সেখানে পোশাকশিল্পে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বাস্তবসম্মত নয়।

বিকেএমইএর এই বক্তব্য অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য আবদার। করোনা সংকটে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা পেলেও গত এপ্রিলে শ্রমিকের মজুরি ৩৫ শতাংশ কম দিয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। পরে ঈদ বোনাসও কম দিয়েছেন তাঁরা। এবার শ্রমিকের বার্ষিক ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) ওপর চোখ পড়েছে মালিকদের। তাঁরা আগামী দুই বছর শ্রমিকের ইনক্রিমেন্ট না দেওয়ার আবদার জানিয়েছেন।

২০১৩ সালের নিম্নতম মজুরি বোর্ডে প্রথমবারের মতো শ্রমিক-কর্মচারীদের মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। পরে ২০১৮ সালের মজুরিকাঠামোতেও তা বহাল রাখা হয়। বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী, সপ্তম গ্রেডের শ্রমিকের মোট মজুরি ৮ হাজার টাকা। তার মধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা।

বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেলে মূল মজুরি ২০৫ টাকা বৃদ্ধি পাবে। আর বাড়িভাড়া বাড়বে ১০২ টাকা ৫০ পয়সা। সাকল্যে শ্রমিকের মজুরি বাড়বে ৩০৭ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যান্য গ্রেডেও একেক হারে মজুরি বাড়বে। এই সামান্য অর্থ না দেওয়ার অভিপ্রায় জানিয়েই শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে বিকেএমইএ।

অন্যদিকে পোশাকশিল্পের মালিকদের আরেক সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি না দিলেও ইনক্রিমেন্ট কয়েক মাস স্থগিত রাখতে শ্রমসচিবকে মৌখিকভাবে অনুরোধ করেছেন। একই সঙ্গে নতুন করে প্রণোদনা পেতে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানতে পেরেছি।

করোনার কারণে গত মার্চে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার পরিস্থিতিতে মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। পরে তহবিলটির আকার বেড়ে ৯ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানামালিক নামমাত্র সেবা মাশুল বা সুদে ঋণ নিয়ে চার মাসের মজুরি দেন। দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানিতে গতি ফিরলেও হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেন গার্মেন্ট মালিকরা। তার আগে এপ্রিলে কারখানা বন্ধের সময়ে ৩৫ শতাংশ মজুরি কম দেন। এমনকি শ্রমিকের ঈদ বোনাসও কম দিয়েছেন অধিকাংশ মালিক। অথচ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে শ্রমিকেরা উৎপাদন করছেন, তাঁদের তো সুপার ইনক্রিমেন্ট দেওয়া দরকার। সারা বছর যে মূল্যস্ফীতি হয়, সেটি সমন্বয় করার জন্যই ৫% ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৫.৭৮%। সুতরাং মজুরি ৫% বাড়লেও মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি সমন্বয় হবে না।

করোনার কারণে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় গত এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। পরের মাসে ১২৩ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়। তারপর রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ১ হাজার ৮৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র দেড় শতাংশ কম। বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে মালিকদের দর-কষাকষি না করে শ্রমিকদের ঘাড়ে পুরোটা চাপিয়ে দেওয়ার এই মানসিকতা কাঙ্ক্ষিত নয়। কাজ হারানো হাজারো শ্রমিকের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে কারখানার

মালিকপক্ষ যত দিন সরকারি ও বিদেশি প্রণোদনার অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে, তত দিন এই বাস্তবতা থাকবে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের নেতৃত্ব অনেক দিন ধরেই তৈরি পোশাকশিল্পের কাছে। লাখো শ্রমিক এই খাতটির সঙ্গে যুক্ত। এই শিল্পের মালিকপক্ষের রয়েছে প্রভাবশালী সংগঠনও। কিন্তু তারপরও যেকোনো দুর্যোগে তারা সবার আগে ‘যায় যায় রব’ তোলে। চার দশক ধরে বিকশিত হওয়ার পরও এবং দেশের শীর্ষ রপ্তানিমুখী খাত হওয়া সত্ত্বেও তৈরি পোশাক খাত এখনো কেন এতটা প্রণোদনানির্ভর?

লেখকঃ মোঃ খাইরুল মামুন মিন্টু

সাংগঠনিক সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *