আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও তার আন্তর্জাতিক পটভূমি

আজ থেকে ৪৯ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। জনগণের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা সেদিন বিজয় অর্জন করেছিলাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় দালালরা ছাড়া সবাই নিঃশঙ্কচিত্তে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেই চির উজ্জ্বল আনন্দময় বিজয় দিবস আজ আরেকবার আমাদের দ্বারে সমাগত। এই সময় স্বাভাবিকভাবেই আমরা পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকাই। আমরা যে বিজয় অর্জন করেছিলাম সেই বিজয়ের বিশ্লেষণ করি, ওইদিনের মতো আপ্লুতভাবে হয়তো নয়, হয়তো কিছুটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে। সেই যুদ্ধে আমাদের সুস্পষ্ট শত্রু-মিত্র ছিল। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলে যেতে পারে, কিন্তু অতীতকে সত্যভাবে তুলে না ধরলে বা ভুলে গেলেই ইতিহাস পাল্টে যায় না। তাই মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কারা আমাদের পক্ষে ছিলেন, কারা আমাদের বিরুদ্ধে ছিলেন, আমাদের শক্তির দিক, আমাদের দুর্বলতার দিক, আমাদের শিক্ষার দিক—এগুলো নিয়ে আমাদের সঠিক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ বারবার নতুন প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা সত্যকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে।

আজকে আমরা এ প্রবন্ধে বিজয় দিবসের আন্তর্জাতিক শত্রু-মিত্রের বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখে তার সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। যদি সেদিক থেকে দেখতে চাই, তাহলে প্রথমেই বলতে হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, দেশের ভেতরেই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে যখন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন—এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বললেন এবং পথও দেখিয়ে দিলেন। যদি দাবিদাওয়া না মেনে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে, তাহলে আমাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করতে হবে। সেটার জন্য আমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে বয়কট করতে হবে, তাদের ভাতে মারতে হবে, পানিতে মারতে হবে ইত্যাদি। তখনই কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই ২ মার্চ হানাদারদের আক্রমণের পর প্রতিরোধ যুদ্ধ দেশের ভেতরেই প্রথম সূচিত হয়, নিরস্ত্র বাঙালিরা যার হাতে যা কিছু আছে তা নিয়েই প্রতিরোধ শুরু করে।

৭ মার্চের পর কার্যত রাষ্ট্রের সব নিয়ন্ত্রণভার বাঙালির হাতে চলে আসে। ৩২ নম্বর রোড থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর তাজউদ্দীন আহমদ তখন যাবতীয় প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করছিলেন। যদিও পাশাপাশি আলোচনার সূত্র তখনো ছিন্ন হয়ে যায়নি। একটি টান টান উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশ তখন এক পা এক পা করে স্বাধীনতার দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী একটি জঘন্য গণহত্যার নকশা প্রণয়ন করে। সেটা হলো অপারেশন সার্চলাইটের ডিজাইন। তারা ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবি সৈন্য এনে টিক্কা খানকে দায়িত্ব দিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা বিশ্বাস করত ও ভাবত, তারা যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালিদের মারতে পারে, হত্যা করতে পারে, গণহত্যা করতে পারে তাহলে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। গণহত্যার একটি বৈশিষ্ট্য হলো তখন আর বাছবিচার করা হয় না; কে অপরাধী, কে যুদ্ধ করছে, কে প্রতিরোধ করছে সেটা বিচার না করে সব ধরনের লোকদের বা একটি সমগ্র জাতি অথবা এথনিক গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। সে অর্থে আমাদের দেশে ২৫ মার্চ থেকে সত্যিই একটা গণহত্যা চলছিল।

কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী যখন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন বিডিআর ও আর্মির একটি অংশ মিলে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। এরপর আমাদের সমগ্র জাতি গণযুদ্ধ শুরু করে। এই গণযুদ্ধটা শুরু করে আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের একটা পশ্চাদভূমি লাগবে। একটা আশ্রয়স্থল লাগবে। সেই আশ্রয়স্থলও আগে থেকেই তৈরি ছিল। আপনারা আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা জানেন। আগরতলা ষড়যন্ত্রে শেষ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বাংলাদেশকে ভারতের সহযোগিতা নিয়ে স্বাধীন করতে চান, বিচ্ছিন্ন করতে চান। আগরতলায় ভারতের সঙ্গে তার একটা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—তাদের সহায়তা নিয়ে তিনি এটা করতে চান। পরে বঙ্গবন্ধু বলেছেন এ ধরনের কিছু অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ তিনি আগে থেকেই করে রেখেছিলেন। যাই হোক আমরা জীবন রক্ষার তাগিদেই প্রায় ১ কোটি শরণার্থী তখন একটা পশ্চাদভূমির প্রয়োজন বোধ করলাম। যেখানে গিয়ে আমরা আশ্রয় নেব, যেখানে আমাদের ঘাঁটি তৈরি হবে, যেখানে আমরা প্রশিক্ষণ নিতে পারব, নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে দেশে এসে ধীরে ধীরে মুক্ত এলাকা গঠন করব। দেশকে হানাদারমুক্ত করা। যেমন মাও সেতুংয়ের চীনে ঘটেছে। চারদিকে মুক্ত এলাকা তৈরি করতে করতে শহরকে গ্রাম দিয়ে ঘেরাও করে পরে শহরে গিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। আমাদের এখানেও মুক্তিযুদ্ধের ডিজাইনটা অনেকটা এমনই ছিল। আমরা বাংলাদেশের চার প্রান্ত থেকে অগ্রসর হয়ে ঢাকা দখল করে দেশকে স্বাধীন করব। এ রকম একটা গণযুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা গেরিলারা যারা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম, তারা ভারতে চলে যাই এবং প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করি। সে অর্থে বলতে হবে, শুরু থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু জাতীয় সহায়তায় কিংবা জাতীয় কাঠামোর মধ্যে এবং জাতীয় শত্রু বা জাতীয় মিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আমাদের আন্তর্জাতিক শত্রু ছিল এবং আন্তর্জাতিক মিত্র ছিল। পাকিস্তানেরও আন্তর্জাতিক মিত্র ছিল, শত্রুও ছিল। এজন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কী প্রতিক্রিয়া হলো, সেটা একটু খতিয়ে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত আমরা জানি যে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রটা আমেরিকার সঙ্গে গভীরভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। তারা মার্কিন সামরিক জোট সিয়াটোর (সাউথ ইস্ট ট্রিয়েটি অর্গানাইজেশন) সদস্য ছিল, তারা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ নিয়ে গঠিত সেন্টোর সদস্য ছিল। পাকিস্তান প্রথম থেকেই আমেরিকার ও যুক্তরাজ্যের সামরিক জোটের সদস্য ছিল। পক্ষান্তরে ভারত কিন্তু কোনো বিশেষ সামরিক জোটের সদস্য হয়নি। আমেরিকানদের সিয়াটোরও নয়, যুক্তরাজ্যের সেন্টোরও নয়, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ওয়ারশ নামক সমাজতান্ত্রিক সামরিক জোট ছিল সেটারও তারা সদস্য ছিল না। তাদের নীতিটা ছিল নেহরুর কথা অনুযায়ী, সক্রিয় জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। সক্রিয় জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি মানেই হলো আমরা কোনো যুদ্ধ জোটে যুক্ত হব না। আমরা তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ রয়েছি যারা পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক শিবিরভুক্ত নই তাদের নিয়ে গঠিত হবে জোটনিরপেক্ষ দেশের জোট (অ্যালায়েন্স অব নন-অ্যালাইন্ড কান্ট্রিজ)। বিশেষ করে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনটা তৈরি হয়েছিল মার্শাল টিটো, নেহরু, নাসের, সুকর্ন, নক্রুমা এবং অন্যান্য যেসব এশিয়া-আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার জাতীয়তাবাদী নেতারা ছিলেন তাদের দ্বারা; যারা সমাজতন্ত্রও না ধনতন্ত্রও না, মাঝামঝি মিশ্র অর্থনীতির গণতান্ত্রিক দেশ ছিলেন; আবার তারা উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদেরও বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ তারা নিজের দেশের শাসনটা আমেরিকার হাতেও দেবেন না, সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতেও দেবেন না। সেই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে মিলেই এ সক্রিয় জোটনিরপেক্ষ নীতির অভ্যুদয় হয়। অর্থাৎ যদি কোনো সাম্রাজ্যবাদী বা আধিপত্যবাদী বৃহৎ শক্তি কোথাও কোনো হস্তক্ষেপ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে তারা থাকবেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তারা সোভিয়েতের পেটের মধ্যে কখনো ঢুকবেন না। কিন্তু ঐতিহাসিক ও সাধারণভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত দেশগুলোর বন্ধুত্বটা বেশি হয়ে যায়, কারণ সাম্রাজ্যবাদই ছিল তাদের প্রধান শত্রু। স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গেও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বন্ধুত্ব সেই সূত্রেই বেড়ে যায়।। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন চাচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক প্রভুর অধীনে যে দেশগুলো আছে, সেই দেশগুলো যাতে ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে তাদের সঙ্গে আসে। এবং তাদের স্বাধীন অর্থনীতিকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা সহযোগিতাও করেছিল। আপনারা জানেন যে নেহরুর আমলে বিভিন্ন যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হয়েছে, সেখানে কিন্তু প্রচুর পরিমাণে সোভিয়েত সাহায্য ছিল। ভিলাই ইস্পাত কারখানাও তারা ভারতকে তৈরি করে দিয়েছিল। সুতরাং এক অর্থে বলা যায়, বহুদিন ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কংগ্রেসশাসিত ভারতের একটা সুসম্পর্ক ছিল। অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের একটা দীর্ঘ সুসম্পর্ক ছিল। এমনকি সোহরাওয়ার্দীসহ আওয়ামী লীগেরও অনেকেই ছিলেন আমেরিকার প্রতি দুর্বল। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার শত্রু ভূমিকা এক্ষেত্রে তীব্র টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছিল।

আমেরিকার তখন আরেকটি স্ট্র্যাটেজি ছিল, চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও চীনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শিবির থেকে আলাদা করে নিজের দিকে নিয়ে আসা। চীনও চাচ্ছিল আমেরিকা যাতে চীনের বিরুদ্ধে আরোপিত ২০ বর্ষব্যাপী (১৯৫০-৭০) অব্যাহত অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়। পুরো ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল প্রথমবারের মতো ১৯৭০ সালে চীন ও আমেরিকার মধ্যে টেবিল টেনিস দলের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। এজন্য সে সময়ের একটা বিখ্যাত কথা চালু আছে পিং পং পলিটিকস বা পিংপং ডিপ্লোমেসি বা পিং পং কূটনীতি। মাও সেতুং তখন চীনের নেতা। অবশ্য সম্ভবত স্তালিনের মৃত্যুর পর থেকেই অর্থাৎ ১৯৭০-এর অনেক আগে থেকেই মাও সেতুংসহ চীনের নেতারা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়ে গেল তখন চীন ও আমেরিকা স্বাভাবিকভাবেই একত্রভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে এবং তারা উভয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সেহেতু তারা পাকিস্তানের পক্ষে থাকবেন। ফলে খুব সহজেই একটা ইকুয়েশন তৈরি হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ একদিকে। আর অন্য পাশে রয়ে যায় চীন, আমেরিকা ও পাকিস্তান। এই ইকুয়েশনটা না বুঝতে পারলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক শত্রু-মিত্র ঠিকভাবে বোঝা যাবে না ।

এখন প্রশ্ন হলো এ ইকুয়েশন তো ঐতিহাসিকভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। আগে থেকেই আমি যে ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ড বললাম, তার থেকে এটাই হওয়ার কথা এবং সেটাই হয়েছে। সেখানে আমাদের পক্ষে এসে সমাজতান্ত্রিক শিবির দাঁড়াবে এবং কীভাবে তারা দাঁড়াল সেটা আমি এখানে আরেকটু বর্ণনা করতে চাই।

প্রথমত আমাদের এখানে যখন ২৫ মার্চের পর গণহত্যা শুরু হলো, তখন সেটার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এটা কি একটা গণহত্যা, এটা কি একটা মুক্তিযুদ্ধ, নাকি এটা একটা অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ—পাকিস্তান ও তার মিত্ররা এ প্রশ্ন তুলে পানি ঘোলা করতে চেয়েছিল। সেজন্য ‘গৃহযুদ্ধ’ না ‘মুক্তিযুদ্ধ’—এ প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। শেখ মুজিবুর রহমান এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলে আগেই তিনি কখনো সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। যদিও বহু আগে থেকে স্বাধীনতাই ছিল তার লক্ষ্য। তিনি শর্ত দিয়ে ৭ মার্চের বক্তৃতা দিয়েছিলেন। যদি এটি হয়, যদি তোমরা এটা করো ইত্যাদি তখন আমরা বাধ্য হব স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে, বাধ্য হব মুক্তিযুদ্ধ করতে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। ভালো করে দেখলে দেখা যাবে এমনকি বক্তৃতায়ও এভাবেই কথাটা আছে। তোমরা যদি আমাদের গুলি করো, তাহলে তোমরা শান্তিতে থাকতে পারবে না। সুতরাং এটা একটি খুবই চমত্কার ডিপ্লোমেটিক বক্তৃতা। যেটার কারণে আমরা বলতে সক্ষম হয়েছি যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে—শান্তিপূর্ণ মীমাংসার রাস্তা তারা রাখেনি। গণতন্ত্র লঙ্ঘন এবং অন্যায়টা যে তাদেরই হয়েছিল, সেই প্রচারের সুবিধাটা আমরা প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পেয়েছিলাম।

মার্চে যে হামলা হলো, গণহত্যা শুরু হলো তখন কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল দলগুলো সব ভারতে চলে গেল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যরা যশোর হয়ে দিল্লি চলে গেলেন। অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই ধীরে ধীরে চলে এলেন কলকাতা হয়ে দিল্লি। সুতরাং দিল্লিতে প্রথম সিদ্ধান্ত হলো যে তদানীন্তন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদের আশ্রয় ও সমর্থন দেবেন।

সুতরাং তখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম চেষ্টা করল আন্তর্জাতিকভাবে কমিউনিস্ট দেশগুলো যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকে। সেজন্য ১৯৭১ সালের মে মাসে সিপিবি সব কমিউনিস্ট দেশে একটা চিঠি পাঠায়। আবার ওই সময় ভারতের সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া), তারা খুব ঘনিষ্ঠভাবে সিপিবিকে সাহায্য করে। ভারতীয় কমিউনিস্টদের মধ্যে কিছু নেতা ছিলেন যাদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আবার কেন্দ্রীয় দিল্লি প্রশাসনেও সোভিয়েতের ও ইন্দিরা উভয়ের বন্ধুস্থানীয়রা ছিলেন। যেমন ডিপি ধর এবং এদের মাধ্যমেই সব মিলিয়ে কমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের যোগাযোগ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যতম প্রথম দিকের দেশ, যারা গণহত্যা বন্ধ করার বিবৃতি দিয়েছিল। তারপর যখন জাতিসংঘে চীন ও আমেরিকা এটা একটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে প্রস্তাব দিল, তখন একাধিকবার সেটার বিপক্ষে ভেটো দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সুতরাং আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেল, এরা এক পক্ষ, ওরা আরেক পক্ষ।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের জন্য ‘ম্যাটেরিয়াল’ সাহায্যের প্রয়োজন আসে। যুদ্ধ করতে হলে তো অস্ত্র লাগবে, রসদ লাগবে, সেটা কোথা থেকে পাওয়া যাবে? তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্র ভারতকে দেয়া হতো এবং ভারত তখন সেগুলো আমাদের গেরিলা ও গণবাহিনীকে দিত। অন্যদিকে আমেরিকা ও চীন অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করত পাকিস্তানকে। বিশেষ করে সিপিবি-ন্যাপ- ছাত্র ইউনিয়নের যে বিশেষ গেরিলা বাহিনী ছিল, তাদের কতগুলো বিশেষ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হয়। সেই বিশেষ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে তারা স্পেশালি ট্রেইনড হয়। তাদের সঙ্গেও সোভিয়েত অস্ত্রপাতি কিছু জোগান ছিল। এটা তখন গোপন ব্যাপার। তবে আমার যতটা জানা আছে কিছু কিছু অস্ত্র সেখানেও এসেছে। যদিও সেটা হয়তো ভারতীয় বাহিনী হয়েই আসত।

যখন বিশ্বব্যাপী এ রকম একটা ব্যাপার স্বীকৃত হয়ে গেল যে, আচ্ছা এটা একটা ন্যায্য মুক্তিযুদ্ধ তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে সমর্থন করে, যেভাবে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন ঔপনিবেশিক দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধকে তারা সাহায্য-সহযোগিতা করে সেই একই ধারায় বাংলাদেশকেও তারা সহায়তা দেয়া শুরু করল। কিন্তু চীন প্রথম থেকেই পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। চীনের তো ভারতের সঙ্গে আগে থেকেই যুদ্ধংদেহী সম্পর্ক ছিল। ষাটের দশক থেকেই ভারতের সঙ্গে চীনের যুদ্ধ হয়। এদিক থেকে চীন আরো বেশি ভয় পেয়ে যায়। চীন ভাবে, যদি বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশ আর ভারত একত্র হয়ে যাবে এবং পাকিস্তান তখন আরো ছোট ও দুর্বল হয়ে যাবে। সুতরাং চীন তখন ভারতের কাছে মিত্রবিহীন হয়ে আরেকটু দুর্বল হয়ে যাবে। এ ক্যালকুলেশন থেকে চীন আরো সতর্ক হয়ে চাচ্ছিল না যে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক।

এছাড়া এখানকার যারা চীনপন্থী কমিউনিস্ট বা অনুসারী ছিলেন, তারা তখন অদ্ভুত থিসিস দিয়েছিলেন। সেটা হলো বাংলাদেশে একটা মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না—এখানে দুই ‘কুকুরের’ লড়াই হচ্ছে। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধারা একটা ‘কুকুর’ এবং পাকিস্তানিরা আরেকটা ‘কুকুর’। দুই ‘কুকুরে’ লড়াই হচ্ছে এবং আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের ‘কুকুরকে’ জিততে দিই, তাহলে তারা এটাকে সিকিম, ভুটান বা তিব্বতের মতো ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করবে। তার চেয়ে আমরা দুই কুকুরের বিরুদ্ধে লড়ব। তবে তাদের মধ্যে খুব ছোট একটি অংশ, মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শিবপুরের একটি অংশ ছিল—তারা বলেছিল, ঠিক আছে এটা দুই কুকুরের লড়াই নয়। এটা একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করব না। আমরা একটি স্বতন্ত্র কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনী করে আমরা একই সঙ্গে স্বাধীনতাও আনব, আবার জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবও করব। অর্থাৎ চীনে যেমন জাপানি সাম্রাজ্যবাদকে তাড়িয়ে একবারে বিপ্লব করে সমাজতন্ত্র করেছে, আমরাও তাই করব। এবং এটা করার জন্য আমাদের দরকার হবে স্বাধীনতা যুদ্ধটা যাতে প্রলম্বিত বা দীর্ঘায়িত হয়। আমরা যেন ভারতে আশ্রয় না নিয়ে দেশের ভেতরে থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে পারি। তবে তাদের একটি বড় অংশ ‘দুই কুকুরের লাইনই’ অনুসরণ করেছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি, অন্ধ মুজিব-বিরোধিতার লাইন অনুসরণ করেছে। অবশ্য কেউ কেউ পরে নিজের ভুল স্বীকার করে লিখিতভাবে আত্মসমালোচনাও করেছেন।

অন্যদিকে মূলধারার বামপন্থী যেমন ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন এভাবে চিন্তা করেনি। তারা বলেছিল, বামপন্থীদের পাল্টা বাহিনী করাটা বিভেদাত্মক হবে। এটা হলো জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। সুতরাং এখানে বামপন্থী আর দক্ষিণপন্থী ভাগ করে আওয়ামী লীগ আর বামপন্থীদের পরস্পরবিরোধী করার প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে এখনকার জাতীয় নেতৃত্ব তাজউদ্দীন আহমদ বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। যদিও তার দলের মধ্যে মোশতাকপন্থী, সাম্রাজ্যবাদপন্থী লোকজন আছে, কিন্তু থাকলেও সেটা প্রধান বিষয় না। সুতরাং আমরা যদি তাজউদ্দীন আহমদসহ একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে পারি তাহলে জাতীয়ভাবেই মুক্তিযুদ্ধ চালানো সম্ভব। সেটা কিন্তু গঠিত হয়েছিলও। সেখানে মওলানা ভাসানীও যোগ দিয়েছিলেন। মণি সিংহ ছিলেন, মোজাফফর আহমেদ ছিলেন, কংগ্রেসের একজন প্রতিনিধি ছিলেন, অবশ্য আওয়ামী লীগই সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এ উপদেষ্টা পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয়ভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তবে যেহেতু বামপন্থীরা আলাদা পরিচয়ের অধিকারী, সুতরাং তাদের প্রশিক্ষণটা আলাদা হবে এবং মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণটাও আলাদা হবে। কোনো কোনো জায়গায় মুজিব বাহিনীর সঙ্গে বামপন্থীদের খণ্ড যুদ্ধও হয়েছে। তবে যেভাবেই হোক না কেন, ঐক্য রক্ষা করে তারা উভয় পক্ষই অগ্রসর হতে চেষ্টা করেছিল। এবং চেষ্টা করেছে যাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত উভয়ই সমর্থন দেয়।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে কোচিনে সিপিআইয়ের একটি কংগ্রেস হয়। সেই কংগ্রেসে পুরো দুনিয়ার কমিউনিস্টরা আসে। সেখানে বাংলাদেশ ও সোভিয়েতের প্রতিনিধিও ছিল। সেখানেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রস্তাব নেয়া হয়। এভাবে কমিউনিস্ট বিশ্বকে আমরা আমাদের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করি।

আবার উল্টো দিকে আওয়ামী লীগের ভেতরে খন্দকার মোশতাক চেষ্টা করেছিল আমেরিকাকে বুঝিয়ে পাকিস্তানকে ঢিলেঢালা কনফেডারেশনের পক্ষে রাজি করাতে। এমনিতেই তো দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, অন্তত পাকিস্তান আর বাংলাদেশ মিলে একটি কনফেডারেশন হোক এটাই ছিল চীন ও আমেরিকার শেষ চেষ্টা। সেজন্য জাতিসংঘে চীন ও আমেরিকা শেষ মুহূর্তে ১৩ ডিসেম্বর যুদ্ধের ‘সিজফায়ার’ প্রস্তাব ওঠায়। আবারো সোভিয়েত রাশিয়া ভেটো দেয়।

সুতরাং অভ্যন্তরের মেরুকরণ হচ্ছিল এবং আন্তর্জাতিকভাবেও মেরুকরণ হচ্ছিল। এভাবে দেশটি স্বাধীনতার দিকে যত এগোতে থাকে, তখন শক্তিগুলোও ভাবতে থাকে যে সামনে কী হবে? স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে? বাংলাদেশ কি সমাজতন্ত্রের দিকে যাবে নাকি ধনতন্ত্রের দিকে যাবে? এখানে একটা অন্যতম ‘ফ্যাক্টর’ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কি বেঁচে থাকবেন, তিনি কি আসবেন, তিনি এসে কোন দিকে যাবেন? তিনি কি ভারতের সঙ্গে মিত্রতা করবেন, তিনি কি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন, তিনি কি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন, তিনি কি ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন, কিংবা তিনি আসলে কী করবেন?

অবশ্য ইতিহাস কখনো কারো জন্য বসে থাকে না। এসব যাবতীয় প্রশ্ন মীমাংসা হয়ে যাচ্ছিল বাস্তব ঘাত-প্রতিঘাত ও ঘটনার মধ্য দিয়ে। বাস্তব ঘাত-প্রতিঘাত বা ঘটনা তো কে কোন পক্ষের সেটা বিবেচনা করে হচ্ছিল না। সেটা যুদ্ধের লজিকে হচ্ছিল। যুদ্ধের লজিক যেটা ছিল তা হচ্ছে তখন দেশ প্রায় স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। মানে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারছিল যে জনগণ যদি সঙ্গে না থাকে, ভাত ও পানি যদি সরবরাহ না হয় এবং কোনো সৈনিককে একা পেলেই লোক যদি তাকে মেরে ফেলে, তাহলে ওই দেশে তো আর থাকা সম্ভব নয়। ওরা যেমন দুঃখ করে বলত, ‘যাব আওয়াম আপকো সাত নেহি রাহেগা তাব…’। আওয়াম মানে জনগণ। যখন আপনার সঙ্গে জনগণ থাকবে না, তখন দখলদার বাহিনী আর বেশিদিন সেখানে থাকতে পারবে না। তবে একটি মুষ্টিমেয় অংশ সক্রিয় রাজাকার বা আলবদর বাহিনীর সদস্য হয়ে বিরোধিতা চালিয়ে গিয়েছিল। তবে তাদের মধ্যে অনেকেই সেখানে নাম লিখিয়েছিল পেটের দায়ে এবং তারা কেউ কেউ নিজ বাহিনীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও করেছে।

সব মিলিয়ে হানাদার বাহিনীর কমান্ডাররা চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা তখন যুদ্ধবিরতি সম্ভব না হলে বৃহৎ শক্তির বহিঃহস্তক্ষেপ প্রার্থনা শুরু করে। তারা চায় আমেরিকা এখানে হস্তক্ষেপ করুক। আমেরিকা এখানে সপ্তম নৌবহর পাঠাক। তারা চায় চীন ভারতকে আক্রমণ করুক। চীন যদি ভারতকে আক্রমণ করে তাহলে ভারতের যোদ্ধারা দুই ভাগ হয়ে দুদিকে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তখন পূর্বভাগে গেরিলা যোদ্ধাদের ভারত খুব বেশি সহায়তা করতে পারবে না। ভারতের ওপর দুটি যুদ্ধের চাপ একসঙ্গে পড়লে, অর্থনীতির ওপর চাপ বৃদ্ধি পেলে ওখানকার জনগণও চাপে পড়বে। তখন তারা বাংলাদেশকে আর আশ্রয় দিতে পারবে না এবং কোটি লোককে খাওয়াতেও পারবে না। সুতরাং তাদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে ওঠে। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রতিবারই ভেটো দিতে থাকে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে তখন একটা ‘ইন্টারেস্টিং হিস্টোরিক’ শান্তি-মৈত্রী-বন্ধুত্ব চুক্তি হয় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের।

এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক অনুকূল উপাদান বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওই চুক্তিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা করে, ‘আমরা দুটো দেশ বন্ধু এবং আমরা যদি তৃতীয় বা বাইরের দেশ দ্বারা আক্রান্ত হই, তাহলে ধরে নিতে হবে অন্যজনও আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং তখন যুদ্ধ অবস্থায় যা করণীয় সেটা করা হবে।’ এটার তাত্পর্য হলো চীন যদি ভারত আক্রমণ করে, তাহলে চীনের যে সীমান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আছে সেই সীমান্ত ধরে তারা তখন একটি ফ্রন্ট খুলবে। ফ্রন্ট খুললে চীন তখন ভারতের সঙ্গে ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দুটো যুদ্ধ একসঙ্গে চালাতে পারবে না। এভাবে চীনকে সংযত করার ব্যবস্থা হয়েছিল। চীন সর্বোচ্চ যেটা করতে পেরেছে সেটা হলো অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু চীনের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আর ভারত ও বাংলাদেশের ভেতরে মাওবাদী নকশালপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। সেটা ভারতেও করেছে আবার বাংলাদেশের মধ্যেও করেছে। এটা গেল একটা দিক।

অন্যদিকে আমেরিকাও বসে থাকল না। প্রথমে তারা খন্দকার মোশতাকসহ অন্তর্ঘাতের চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষ মুহূর্তে নিক্সন বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গোপসাগর দিয়ে সেটি যদি চট্টগ্রামে আসতে পারে, তবে ভারত আর নিজস্ব বাহিনী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একত্র হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে সাহস করবে না। আর ঢুকলেও তখন আমেরিকা বলবে, ভারত একটি তৃতীয় দেশ হয়ে যখন বাংলাদেশে ঢুকেছে, সুতরাং এটা এখন আন্তর্জাতিক যুদ্ধ। এভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বযুদ্ধের মতো একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়।

সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন খুব সিম্পল একটি হুমকি দেয়। তারা বলে, বঙ্গোপসাগরে যদি সপ্তম নৌবহর ঢোকে তাহলে বঙ্গোপসাগর পাহারা দেয়ার জন্য সেখানে আমরা অ্যাটমিক নিউক্লিয়ার সাবমেরিন পাঠাব। এতদূর কিন্তু ভারতের ক্ষমতায় ছিল না। আমাদের বাংলাদেশের তো কেবল রাইফেল, মেশিনগান, স্টেন আর মর্টার। সুতরাং তখন অত ক্ষমতা আমাদের ছিল না, বিগ প্লেয়ারদের খেলা চলছিল তখন। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতে একটার পর একটা শহরের পতন হতে থাকল। হানাদাররা সব পিছু হটতে হটতে ঢাকায় এসে জমা হতে থাকল। এরপর একটা প্রশ্ন এল, কার কাছে আত্মসমর্পণ করবে পাকিস্তানি বাহিনী। তখন ঠিক হলো, আচ্ছা ভারতীয় বাহিনীও থাকবে আবার ওসমানীও থাকবে। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটা ঠিকমতো হয়নি। তবে যেটাই হোক শেষ পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ও আমরা বিজয় অর্জন করি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

লেখকঃ অধ্যাপক এম এম আকাশ

(১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর ২০২০,দৈনিক বনিক বার্তায় প্রকাশিত )

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *