আজ ১৬ ডিসেম্বর। ৪৯ বছর আগের এই দিনে দীর্ঘ গণসংগ্রামের পথ ধরে নয় মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ে পাকিস্তানি জান্তাবাহিনী থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনে বীর বাঙালি। আজকের এই বিজয় উদযাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার বিজয়ের ৫০ বছরে পদার্পন করতে যাচ্ছে।
শ্যামল সবুজ বাংলার জমিনে লাখো শহীদ তাদের বুকের রক্ত ঢেলে এনেছে রক্তিম সূর্য। তাই এই বিজয়ের অনুভূতিই অন্যরকম। সবুজের বুকে লাল রক্তিম বৃত্তে মিশে আছে সকল শ্রেণির, সকল ধর্মের বাঙালির রক্ত।
এই বিজয়ের পটভূমি রচিত হয়েছিল ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৮-৬৯ সালের জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি সংগ্রামেই রক্ত দিয়েছে মধ্যবিত্ত ও কৃষকের সন্তান, ছাত্র সমাজ, শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষ। প্রতিটি সংগ্রামের গতিমুখ ছিল বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বায়ত্বশাসন, স্বাধিকার আইন যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নেয় এবং বাঙালি জাতি এই সংগ্রামে বিজয় অর্জন করে।
এই দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রাম কখনো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার প্রশ্নে, কখনো শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রশ্নে, কখনো বা স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রশ্নে গড়ে ওঠে। এই পথ সহজ সরল ছিল না- ছিল বন্ধুর। কোনো সময় এই খণ্ডযুদ্ধে আমরা বিজয় লাভ করেছি, আবার কোনো সময় পিছু হটে আরো শক্তি সমাবেশ ঘটিয়ে অগ্রসর হয়েছি।
শিক্ষণীয় হচ্ছে গণঅভ্যুত্থান, তার পটভূমিতে নির্বাচন এবং নির্বাচনের গণরায় প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র লড়াই। লড়াইয়ের এই তিনটা রূপ একই ফ্রেমের ভেতর ফেলে দেখলে বর্তমানের সংগ্রামের একটা পথের দিশা পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, যখনই শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষ এই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন তখনই এই সংগ্রাম অসীম বলে বলীয়ান হয়ে অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে বিজয়ের ভিত্তি রচনা করেছে।
আমাদের সমাজে গত কয়েক দশকে মধ্যবিত্তের আকারের একটা স্ফীতি ঘটছে। মূলত বিশ্বব্যাংক আইএমএফ নির্দেশিত যে উন্নয়ন মডেল তারই উচ্ছিষ্ট ভোজী হিসেবে একশ্রেণির মধ্যবিত্ত গড়ে উঠেছে। তাদের কাছ থেকে ষাটের দশকের মধ্যবিত্তের ভূমিকা প্রত্যাশা করা যায় না। তার বাইরে মধ্যবিত্তের একটা অংশ আছে যারা অনেক রেডিক্যাল চিন্তা-ভাবনা করে, মাঝে মাঝে বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। তার প্রমাণ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ আদালত এবং সাম্প্রতিককালে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ। এই দুটোতেই মধ্যবিত্তের ভূমিকা ছিল প্রধান। আবার স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী সংগ্রামে মধ্যবিত্তের বিরাট ভূমিকা থাকলেও শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদেরও বিরাট ভূমিকা ছিল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সূচনাই করেছিল শ্রমিকরা। মুক্তিযুদ্ধ ছিল নানা শ্রেণির সম্মিলিত একটি জাতীয় সংগ্রাম। এই জাতীয় ঐক্যের যেমন বিরাট সবলতার দিক রয়েছে ঠিক তেমনি এর ভেতরে নানা স্রোতের সংঘাত অন্তঃশীলা প্রবাহের মত ক্রিয়াশীলও ছিল।
কিন্তু বিজয় লাভের পরপরই বাঙালি পেটি বুর্জোয়া যখন পেটি কেটে বুর্জোয়া হওয়ার উগ্র বাসনা নিয়ে নানা তৎপরতা শুরু করল, মধ্যবিত্তের একাংশ যখন লুটপাটের মধ্য দিয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তখনই বিজয় তার জাতীয় রূপ হারিয়ে ফেলতে শুরু করল। শ্রমিক-কৃষক-দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত, যারা বিজয় অর্জনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল, তারা এই বিজয়ের মধ্যে তাদের বিজয় খুঁজে পেল না। পাকিস্তান আমলের উপনিবেশিক ধরনের শাসন শোষণের অমানিশার অন্ধকার ভেদ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে প্রত্যাশায় উদিত হয়েছিল নতুন সূর্য, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে নানা স্বার্থের টানাপোড়েনে সে প্রত্যাশা হতাশার কালো পর্দায় আবৃত হতে শুরু করে।
এদেশের শ্রমিক অথবা কৃষকেরা সংখ্যাগুরু, তারাই স্বাধীনতার জন্য বেশি ত্যাগ করেছে, আত্মবলিদান করেছে। অথচ তাদের ঘরে এখনও বিজয়ের আনন্দ পৌঁছেনি। তাদের আনন্দ দিতে না পারলে বিজয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই অসম্পূর্ণ বিজয় সম্পূর্ণ করতে হলে- অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত করতে হবে। এই যুদ্ধে ’৭১ সালের মতো হয়তো শ্রেণি বিন্যাস ঘটবে না। নতুন করে শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করে তীব্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সে লড়াই শুরু করতে হবে। সে লড়াই যতই জোরদার হবে ততই দুর্বল হবে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। ততই উন্মুক্ত হবে সকলের স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের দ্বার।