এ কথা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্য সব মানুষের মতোই ভালো-মন্দ মিলিয়ে এই মর্তেরই রক্ত-মাংসের একজন মানুষ।

“এ কথা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্য সব মানুষের মতোই ভালো-মন্দ মিলিয়ে এই মর্তেরই রক্ত-মাংসের একজন মানুষ। তিনি অতিমানব ছিলেন না। কিন্তু ‘মানুষের’ মতোই ‘একজন’ হলেও তিনি ছিলেন এক ‘অনন্য’ একজন। দেশ ও কালের গন্ডির মাঝে থেকেও তিনি ছিলেন ‘যুগের মহানায়ক’।”

“চূড়ান্ত বিচারে সমাজের বাস্তবতা ও সমাজবদ্ধ জনগণই একজন ব্যক্তিকে গঠন ও বিকশিত করতে পারে। এসব কথা যেমন সমাজের একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা একইভাবে প্রযোজ্য সমাজের ‘মাথায়’ যারা থাকেন তাদের ক্ষেত্রেও। সে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।”

“শেখ মুজিবুর রহমান তার জন্মলগ্ন থেকেই ‘জাতির পিতা’ ছিলেন না। শুরুতে তিনি ছিলেন দুরন্ত এক কিশোর – ‘মুজিবর’। অনেকের কাছে ‘মুজিব ভাই’। এর পর ‘মুজিবুর রহমান’ অথবা শেখ মুজিবুর রহমান। তার পর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল ‘শেখ সাহেব’। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। একাত্তরের পর তিনিই স্বাধীন দেশের স্থপতি ‘জাতির পিতা’। তিন দশক সময়কালের রাজনৈতিক জীবনে এভাবেই ঘটেছিল ইতিহাসের ‘মহানায়ক’ হয়ে উঠতে পারার পথে তার উত্তরণ।”

“তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও জীবন দর্শনেরও উত্তরণ ঘটেছিল। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটি ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্র-কর্মী হিসেবে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর স্লোগানধারী জঙ্গিকর্মী হিসেবে। কিন্তু সে সময়ও মুসলিম লীগের মধ্যে উদারনৈতিক ও কিছুটা গণমুখীন যে প্রবণতা ও অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আবুল হাশেম-সোহরাওয়ার্দীর অংশের অনুগামী এবং ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরোধিতাকারী।
বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে ছিলেন নেতাজি সুভাষ বোসের ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট – এই তিনটি দলের ঝান্ডা নিয়ে কলকাতায় ‘রশিদ আলী দিবস’ পালনসহ নানা কর্মসূচিতে তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী যৌবনদীপ্ত অংশগ্রহণকারী। মুসলিম লীগের কর্মী হলেও তখন থেকেই তিনি ছিলেন গণমুখী ধারার লোক। একই সঙ্গে তার মাঝে প্রবিষ্ট হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা বোধের প্রাথমিক উন্মেষ।”

“পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা দলের নেতৃত্ব করায়ত্ত হওয়া ইত্যাদি ‘শেখ মুজিব’কে অতিদ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করে তুলেছিল। সাধারণ কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি জেলে গিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে উঠেছিলেন।”

“সোহরাওয়ার্দী সাহেব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা – এ দুটি মৌলিক প্রশ্নে দলের ঘোষিত নীতি-আদর্শ থেকে আওয়ামী লীগ সরে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়েছিল। নবগঠিত ন্যাপের ওপর রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাপের সম্মেলনের অধিবেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী-হামলাবাজি চলেছিল।
কিন্তু ‘শেখ সাহেব’ অচিরেই বুঝতে সক্ষম হন যে, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু তার ‘নেতা’ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। তাই অ্যাসেম্বলিতে ন্যাপ উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানের জন্য দলের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই সিদ্ধান্ত অমান্য করেছিলেন।”

“এ কথা ঠিক যে, চূড়ান্ত বিচারে জনগণই হলো ইতিহাসের স্রষ্টা। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও অসত্য নয় যে, ইতিহাস সৃষ্টিতে ব্যক্তির ভূমিকাকেও অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা যায় না। ইতিহাসই ‘ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের’ জন্ম দেয়। ইতিহাসের নিজস্ব প্রয়োজনেই বিশেষ মুহূর্তে ‘ইতিহাস’ নিজেই এসব ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের যুগান্তকারী ঘটনাবলির প্রাণকেন্দ্রে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ইতিহাসের হাতে তৈরি হওয়া সেই ব্যক্তিরাই আবার ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে ওঠেন। জনগণ ও ব্যক্তির ভূমিকা এভাবে পরস্পর পরিপূরক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াতেই নতুন ইতিহাস রচিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল সেরূপ নিয়ামক।”

“আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শধারা, বাংলাদেশের জন্ম – এসব ঐতিহাসিক অর্জন সম্ভব হয়েছে প্রধানত জনগণের অমোঘ শক্তির ফলে। তা ছাড়া তা সম্ভব হয়েছে শেরেবাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, মণি সিংহ প্রমুখ অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তির ত্যাগ-তিতিক্ষা-অবদানে। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের ‘নেতা’। এ সত্যকে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়াটি হবে এক ধরনের ‘ইতিহাস বিকৃতি’।”

“তবে এসব কালজয়ী ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের মধ্যে যিনি ঠিক ক্রান্তিকালীন বিশেষ সময়টিতে জনগণের সংগ্রাম, আশা, আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-সাধনা, মনের ইচ্ছাকে সবচেয়ে উপযুক্ত ও বলিষ্ঠভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি হলেন বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে কারণেই তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় জনগণের অন্তরে ও বাস্তব বিচারে তার অবস্থান অন্য সব ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ঊর্ধ্বে জায়গা করে নিতে পেরেছিল।”

লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *