৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৈশকালীন ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারে অধীনে এবং সরকারের তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে এ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না যে, এই নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কি না? এমন এক পরিস্থিতি আমাদের পার্টি, সিপিবি নির্বাচনী লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। রাজপথের ভোটের অধিকার লড়াইয়ের অংশ রূপে এবং নৌকা-ধানের শীষকে কেন্দ্র করে মানুষকে দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক শেকলে পুনরাবৃত্তি করবার সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করতে সিপিবি’র এই সিদ্ধান্ত। বিকল্পের পতাকা, মেহনতি জনতার ‘কাস্তে’ প্রতীক ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনে লড়বে। এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে মেহনতি জনতা উচ্চারণ করবে এ ঢাকা উত্তর মহানগরে তার হিস্যার দাবি।
এ মহানগর কার? এ মহানগরে থাকবে কারা? এখানে শুধুই কি বড়লোক ও ক্ষমতাসীনরা থাকবে? নাকি এ নগরটি সকল মানুষের হবে? এ নগরে বাস করছে লক্ষ লক্ষ সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত, গার্মেন্ট শ্রমিক, রিক্সা শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, কারখানার শ্রমিকসহ নানা ক্ষেত্রে কর্মরত মেহনতি জনতা। এরাই মহানগরের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ। যারা সিটি কর্পোরেশনের সেবা থেকে বঞ্চিতই শুধু নয়, এ নগরে দিন গুজরান করে দুঃসহ এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। ঢাকা মহানগরের উত্তরে নিম্ন আয়ের বস্তিবাসী ৩০ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে। স্যাঁতস্যাঁতে, ৮ ফিট বাই ৮ ফিট একটা ঘরের জন্য যে ভাড়া একজন গরিব বস্তিবাসীকে দিতে হয় তা অনেক ক্ষেত্রে গুলশান, বনানী, বারিধারার উচ্চবিত্তের মানুষদের প্রতি স্কয়ার ফিটের ভাড়ার চেয়ে বেশি। সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তের আয়ের প্রায় ৬০/৭০ ভাগ, অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি চলে যায় বাড়ি ভাড়া পরিশোধে। যেখানে পেঁয়াজ, চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে যায়, সেখানে এ বাড়ি ভাড়া পরিশোধে মধ্যবিত্তদের নির্মম এক যন্ত্রণার মাঝে ঢাকায় টিকে থাকতে হয়।
এ শহর, এ নগর তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে, নিশ্চিন্ত, সুস্থির আবাস দিতে ব্যর্থ। উপকূলের দুর্যোগ পীড়িত, উত্তরের অভাব তাড়িত কিংবা কৃষি জীবন ছেড়ে আসা যে কোনো মানুষই আজ ঢাকা শহরে অসহায়। এ শহরে ঘরের আশায় এসে সকলেই এক বন্দী জীবনযাপন করছে। এই ঢাকা মহানগর বাসযোগ্যতা হারিয়েছে অনেক পূর্বেই। আন্তর্জাতিক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় ঢাকা পৃথিবীর তৃতীয় নিকৃষ্টতম শহর। ঢাকার থেকে নিকৃষ্টতম শহর পৃথিবীতে রয়েছে মাত্র দুটি। একটি হলো– সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরী দামেস্ক, অপরটি নাইজেরিয়ার লাগোস।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছে বিষাক্ত নগরীতে। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগরী আর ভারতের দিল্লি সমানে সমানে রয়েছে। বিগত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত দিল্লি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত, বর্তমানে ঢাকার বায়ু দুনিয়ার সর্বোচ্চ দূষিত বায়ু। ঢাকা মহানগরের মানুষদের প্রতি মুহূর্তে এ দূষিত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হচ্ছে। শুধু বায়ু নয়, পানি, শব্দ, খাদ্যসহ পুরো পরিবেশ আজ বিষাক্ত আর মৃত্যুদায়ী। ঢাকা মহানগরের সবচেয়ে কম শব্দ দূষণ ঘটে উত্তরা এলাকায়। উত্তরায় শব্দের মাত্রা ১২০ ডেসিবল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী একটি শহরে শব্দ ২০ ডেসিবল পর্যন্ত সহনীয়। তাহলে বুঝে নিতে হবে বাকী শহরের শব্দ দূষণ স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর, হুমকিস্বরূপ। খাদ্যে ভেজাল বহুল সমালোচিত একটি বিষয় হলেও প্রদর্শনবাদী কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে খাদ্য ভেজাল বন্ধ হয়নি। খাদ্যে ভেজাল দিয়ে প্রতিনিয়ত নীরব হত্যাকাণ্ড চলেছে এ শহরে।
এসবের হাত থেকে রক্ষা পেতে, কোনো ত্বরিত ব্যবস্থার গ্রহণের উদ্যোগ সরকার বা সিটি কর্পোরেশন, কারোরই নেই। মুক্ত বাজারের এ যুগ যেন শুধু মুনাফা অর্জনের আর লুটপাটের। তাই বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার স্বদিচ্ছা বা উদ্যোগ ক্ষমতাসীনদের নেই। রাজধানী ঢাকা নারীর জন্য নিরাপদ নয়। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে পদার্পিত হতে চলেছে বাংলাদেশ। অথচ ঢাকা মহানগর নারীবান্ধব করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। হরহামেশাই ঘটে চলেছে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি। দিনে বা রাতে চলেছে নারী ধর্ষণ। ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় ৮০ শতাংশ গার্মেন্ট শ্রমিক হয় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন কিংবা প্রত্যক্ষ করেছেন। ২০১৮ সালে কর্মস্থলে বা গণপরিবহনে যাতায়াতকালে নারীদের অধিকাংশই নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। (অপঃরড়হ অরফ, ২০১৮)। যে শহর নারীর সম্মান করতে জানে না, নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই শহর নগরের মেয়ররা দিব্যি বুক ফুলিয়ে মহাউন্নয়ন নিয়ে কণ্ঠবাজী করে চলেছে। উন্নয়নের বলিহারী চারিদিকে, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীদের বয়ানে, কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচারণায়। অসহনীয় যানজট, জলাবদ্ধতা, ত্রুটিপূর্ণ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সমাধান নেই। বর্জ্য নিষ্কাশনেও চরম ব্যর্থ। বিগত ২০১৯ সালে মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করে ডেঙ্গু জ্বর। আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা নিধন করতে পারেনি মেয়রদ্বয়।
ঢাকা উত্তরের সিটি কর্পোরেশন এডিস মশা (যে মশা জন্ম নেয় স্বচ্ছ, পরিষ্কার পানিতে) মারতে গিয়ে কিউলেক্স মশা (যে মশা জন্ম নেয় নোংরা, ময়লাযুক্ত পানিতে) মারার ভুল উদ্যোগে কোটি কোটি টাকা অপচয় করেছে। আমার প্রাণের শহর ঢাকা এ শহরটা আমাদের সকলের প্রাণের শহর। বাংলাদেশের প্রাণভোমরা বলা অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু এ শহর নিয়ে শাসকশ্রেণি শুধুই লুটপাট করে চলেছে। এ শহরকে মানুষের জন্য বাসযোগ্য করতে হবে। কেবল বড়লোক, ধনী আর ক্ষমতাসীনদের জন্য নয়– সকল নাগরিকের জন্য, সবার জন্য বাসযোগ্য ঢাকা মহানগর উত্তর গড়ে তুলতে হবে। একটি পরিবেশবান্ধব, নারীর জন্য নিরাপদ ঢাকা গড়ে তুলতে হবে। ঢাকার সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত ও মেহনতি জনতার পক্ষ থেকে আসন্ন উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী আমি স্বপ্ন দেখি পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ, বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার। পরিচ্ছন্ন ঢাকার জন্য পরিচ্ছন্ন রাজনীতি প্রয়োজন।
বাসযোগ্য ঢাকার জন্য প্রয়োজন বিকল্প নেতৃত্ব। ঢাকা উত্তরকে পরিবশেবান্ধব, বাসযোগ্য ও সবার জন্য ঢাকায় রূপান্তরিত করতে আমাদের পরিকল্পনা
১. ৮টি মন্ত্রণালয়ের ৫৬টি প্রতিষ্ঠান ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব সংস্থার সমন্বয়ের জন্য ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ‘নগর সরকার’ আইন প্রণয়নের জন্য সরকার ও সংসদের নিকট প্রস্তাব করা হবে। প্রয়োজনে ঢাকার জনগণকে সাথে নিয়ে ‘নগর সরকারের’ দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।