শ্রমিকের রক্তে ভেজা একুশ শতকের বাংলাদেশ: এক নীরব গণহত্যা

Biplobider Barta
  • আপডেট : মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শ্রমিকের ঘামে ভেজা এই ভূখণ্ড, তাদের রক্তে রাঙানো এই মাটি এখানেই জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন রাষ্ট্র। যে দেশ তার স্বাধীনতার জন্য অগণিত মানুষের জীবন উৎসর্গ করেছে, সে দেশেই আজ শোষণের এক নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। একুশ শতকের এই তথাকথিত সভ্য সমাজে দাঁড়িয়েও যখন দেখি, শ্রমিকের জীবন বুলেট আর লাঠির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, তখন মনে হয়, আমরা কি সত্যিই বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলাম? যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সাম্য ও ন্যায়ের, সেই স্বপ্ন আজ বুলেটের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ। রাষ্ট্রের চোখে শ্রমিকেরা আজও মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারে না, তারা রয়ে যায় কেবলই ‘শ্রমিক’ হয়ে একটি উৎপাদনী যন্ত্রের অংশ মাত্র।

এই নির্মম বাস্তবতা আরও একবার সামনে এসেছে এভারগ্রিন প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরি বিডি লিমিটেডের (হংকং) শ্রমিক আন্দোলনে। শ্রমিকেরা চেয়েছিল তাদের ন্যায্য অধিকার। তাদের দাবি ছিল অবৈধ ছাঁটাই বন্ধ, বন্ধ কারখানা চালু করা এবং অন্যান্য ২৩ দফা দাবি পূরণ। এই দাবি কি খুব বেশি কিছু ছিল? যে শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে কারখানার চাকা সচল রাখে, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, সেই শ্রমিকের জন্য কি সামান্য ন্যায্য অধিকারটুকুও প্রাপ্য নয়? কিন্তু এই যৌক্তিক দাবির জবাবে তারা পেয়েছে নির্মমতা। যৌথবাহিনীর নির্বিচার গুলির শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন হাবিবুর রহমান নামের এক তরুণ শ্রমিক, আর গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও প্রায় ১২ জন।

হাবিবুর রহমান, নীলফামারীর এক সাধারণ যুবক, যার চোখে ছিল স্বপ্ন। সে তো কেবল নিজের শ্রমের ন্যায্যতা চেয়েছিল। তার অপরাধ কী ছিল? তার অপরাধ ছিল, সে মানুষ হয়েও রাষ্ট্রের কাছে তার অধিকার চেয়েছিল। যে রাষ্ট্র তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তিকে সম্মান জানাতে পারে না, সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য কি উৎপাদিত পণ্যের চেয়েও সস্তা? এই প্রশ্নটি বারবার মনের মধ্যে উঁকি দেয়। নির্মম বাস্তবতা হলো, হ্যাঁ, এই রাষ্ট্রে একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য সত্যিই সস্তা। কারণ, শ্রমিকদের রক্ত ঝরলে তার কোনো বিচার হয় না, কোনো জবাবদিহি থাকে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মূল দায়িত্ব ছিল শ্রমিকদের দাবিগুলো নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে একটি আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু তারা তা না করে উল্টো শ্রমিকদের উপর গুলি চালিয়েছে। এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। অতীতেও বিভিন্ন সরকারের আমলে শ্রমিকেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বুলেটের শিকার হয়েছেন। এই রক্তক্ষয়ী ইতিহাস আবারও প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে শ্রমিকের জীবন তুচ্ছ। যে রাষ্ট্র তার জনগণের জানমাল রক্ষায় ব্যর্থ, সে রাষ্ট্রকে কি সত্যিই জনগণের রাষ্ট্র বলা যায়?

একটি কারখানার মূল্য, তার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য এসবের চেয়ে একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য অনেক বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। এই বৈষম্য আর অবজ্ঞার কারণেই শ্রমিকেরা বারবার প্রাণ হারাচ্ছেন, আর এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হচ্ছে না। গত বছর, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে শুধু বেতন বৃদ্ধি, ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি, হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, টিফিন বিল বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন ন্যায্য দাবির জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এই তিন মাসে কত মামলা হয়েছে, কতজন শ্রমিক কারাবরণ করেছেন, তার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া না গেলেও এটা স্পষ্ট যে, শ্রমিক অসন্তোষ এবং আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে হাজার হাজার শ্রমিককে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে এবং বহু শ্রমিককে কারাবরণ করতে হয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এই শিল্পের শ্রমিকদের দুর্দশা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চাকরিচ্যুতি, কারখানা বন্ধ, মামলা, কারাবরণ এবং শ্রমিক হত্যার মতো ঘটনা শ্রমিকদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। যারা গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করেছিলেন, তাদের আমলেও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য বদলায়নি। তাদের জন্য নেই চাকরির নিশ্চয়তা, নেই কর্মক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ। অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, নতুন কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ নেই। আর যখন শ্রমিকেরা কারখানা বন্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে যায়, তখন তাদের ওপর হামলা হয়, মামলা হয়, এমনকি গুলিও খেতে হয়।

গণতন্ত্রের নামে এক অদ্ভুত বৈষম্য চলছে এই রাষ্ট্রে। আমরা দেখেছি, যখন একদল আন্দোলনকারী তাদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামে, তখন তাদের ওপর ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে স্বাগত জানানো হয়। আর যখন শ্রমিকেরা তাদের জীবন-জীবিকার দাবি নিয়ে রাস্তায় নামে, তখন তাদের ওপর বুলেট ছোড়া হয়। এই দ্বিমুখী আচরণ প্রমাণ করে, এই রাষ্ট্রযন্ত্র আসলে কাদের স্বার্থ রক্ষা করে। মব সন্ত্রাস দমনে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া সরকার শ্রমিকদের উপর আঘাত করে প্রমাণ করছে যে, তারা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী সরকার নয়, বরং পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার।

শ্রমিকের রক্ত ঝরছে, কিন্তু তার অধিকারের পথ এখনও মসৃণ হয়নি। এই নির্মম বাস্তবতা কি বদলাবে না? রাষ্ট্র কি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি, অর্থাৎ শ্রমিকদের, মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে শিখবে না? যতদিন এই প্রশ্নের উত্তর না মিলছে, ততদিন শ্রমিকদের লড়াই চলবে, আর ঝরতে থাকবে তাদের রক্ত। এই লড়াই শুধু বেতন বা বোনাসের জন্য নয়, এই লড়াই বাঁচার জন্য, সম্মান নিয়ে টিকে থাকার জন্য। যতদিন পর্যন্ত এই রাষ্ট্র তার শ্রমিকদের প্রতি অবিচার করে যাবে, ততদিন পর্যন্ত এই নীরব গণহত্যা চলতে থাকবে। আর এই নীরব গণহত্যা বন্ধ করার একমাত্র উপায় হলো, শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই।

লিখেছেনঃ খাইরুল মামুন মিন্টু, আইন ও দর কষাকষি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

আরো পড়ুন

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭৩০৩১
© All rights reserved © biplobiderbarta
Developer Design Host BD