কিছু কারখানা শ্রম আইনের ১২(৮) ধারায় কারখানা বন্ধের নোটিশ দেওয়ায় ঈদ-পরবর্তী বন্ধের দিনগুলোতে শ্রমিকেরা মূল মজুরির অর্ধেক পাবেন।
করোনা সংক্রমণ রোধে চলমান ১৪ দিনের বিধিনিষেধে কোনো ছাড় পাচ্ছেন না রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা। ৫ আগস্ট পর্যন্ত বন্ধই থাকছে কারখানা। ঈদের ছুটি ও বিধিনিষেধের কারণে টানা ১৯ দিন কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকায় সময়মতো পণ্য রপ্তানিতে ব্যর্থ হবেন অনেক মালিক। নতুন ক্রয়াদেশ পাওয়ার বিষয়টিও আপাতত থমকে আছে।
ব্যবসায়িকভাবে কিছুটা ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিতেই শ্রমিকদের মজুরিতে হাত দেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন মালিকেরা। ইতিমধ্যে কিছু কারখানা শ্রম আইনের ১২(৮) ধারায় কারখানা বন্ধের নোটিশও দিয়েছে। সেটি বাস্তবায়িত হলে ঈদের পর বিধিনিষেধের কারণে কারখানা বন্ধের দিনগুলোতে শ্রমিকদের মূল মজুরির অর্ধেক মিলবে। এমনকি আগস্ট মাসের প্রথম পাঁচ দিনের মজুরিও কম পাবেন তাঁরা। তবে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, খাদ্যসহ অন্যান্য ভাতা কাটা হবে না। অবশ্য অনেক প্রতিষ্ঠান কারখানা খোলার পর ওভারটাইম ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শ্রমিকদের কাজ করিয়ে চলমান বিধিনিষেধের ছুটি সমন্বয়ের পরিকল্পনা করেছে।
এদিকে শ্রমিকের মজুরি কর্তনের বিরোধিতা করে শ্রমিকনেতারা বলছেন, করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকেরা কাজ করছেন। বর্তমানে পোশাকের ক্রয়াদেশও প্রচুর। তা ছাড়া কারখানা বন্ধের জন্য শ্রমিকেরা দায়ী নন। ফলে কোনোভাবেই মজুরি কর্তন চলবে না। বেআইনি কিছু করা হলে আন্দোলন।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে চলতি বছরের এপ্রিলে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করলেও রপ্তানিমুখী পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা উৎপাদন চালানোর সুযোগ পায়। সর্বশেষ গত ২৮ জুন শুরু হওয়া সীমিত ও পরে ১ থেকে ১৪ জুলাই কঠোর বিধিনিষেধেও পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা চালু ছিল। তবে ২৩ জুলাই শুরু হওয়া কঠোরতম বিধিনিষেধে সব ধরনের শিল্পকারখানা বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর পোশাক ও বস্ত্র খাতের পাঁচ সংগঠনের নেতারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেন। তবে শেষ পর্যন্ত সরকার নমনীয় হয়নি।
পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা ঈদের আগে সদস্যদের বার্তা দিয়েছিলেন, করোনা সংক্রমণ কমে এলে ১ আগস্ট থেকে কারখানা খুলে দেওয়া হতে পারে। সে অনুযায়ী প্রায় সব কারখানাই ঈদে শ্রমিকদের সাধারণ ছুটি দেয়। তবে গতকাল মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, চলমান বিধিনিষেধে শিল্পকারখানা খোলার জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ থাকলেও তা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘কমবেশি সব কারখানাই আর্থিক সংকটে আছে। ফলে চলতি মাসের মজুরি দিতে সবাই হিমশিম খাবে। ১ আগস্ট কারখানা খোলার সুযোগ পাব, সেই আশায় আমরা সদস্যদের লে-অফ না করতে অনুরোধ করেছি। সেটি না হলে কারখানাগুলোকে লে-অফ করা থেকে আটকানো যাবে না।
করোনার প্রথম ধাক্কায় গত বছরের এপ্রিলে তিন সপ্তাহের মতো পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। ওই সময়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা মোট মজুরির ৬৫ শতাংশ অর্থ পান। যদিও এর আগেই শ্রমিকদের তিন মাসের মজুরি দিতে সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করে। পরে তিন মাসের পরিবর্তে চার মাসের মজুরি দেওয়ার জন্য প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পান পোশাকশিল্পের মালিকেরা।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ঈদের আগে বেতন-বোনাস দিতে অধিকাংশ কারখানা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। ঈদের পর পণ্য রপ্তানি হলে সেগুলো সমন্বয় হবে। কারখানাগুলোকে আমরা ১২(৮) ধারায় বন্ধ অথবা চলমান বিধিনিষেধের ছুটির পরবর্তী সময়ে সমন্বয় করার পরামর্শ দিচ্ছি।
এদিকে করোনার প্রথম ধাক্কায় পোশাক রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমলেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি।
জানতে চাইলে শ্রমিকনেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, কোনোভাবেই শ্রমিকের মজুরি কাটা যাবে না। বর্তমানে কারখানাগুলোতে প্রচুর ক্রয়াদেশ আছে। রপ্তানিও ভালো অবস্থানে রয়েছে। তা ছাড়া শ্রমিকের নিরাপত্তারও দরকার আছে। মালিকেরা মুনাফা করলে কি মুনাফার ভাগ দেন? দেন না। তাহলে কয়েক দিনে যদি অল্প কিছু লোকসান হয়েও থাকে, সেটির ভাগ কেন শ্রমিকেরা নেবেন?
।।২৮ জুলাই ২০২১, প্রথম আলো প্রকাশিত।।